কারোর হাতে লাঠি, কেউ আবার অসিচালনার অনুশীলন করছে। কেউ সাইকেল নিয়ে চক্কোর কাটছে মাঠের চারদিকে। সকলেই কিশোরী, সকলের বয়সই ১২-১৫ বছর, কিংবা আরেকটু বেশি। আর তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বছর তিরিশের এক তরুণ।
লাঠি-তরবারির দিন শেষ হয়েছে বহুদিন। তবে শহর, শহরতলি কিংবা মফঃস্বলে ক্যারাটে বা অন্যান্য মার্শাল আর্টের প্রশিক্ষণ নিতে দেখা যায় কিশোরী, তরুণীদের। তাছাড়া পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে জিম। সেখানেও অবাধ প্রবেশ মহিলাদের। কিন্তু আজ থেকে একশো বছর আগে এমনটা স্বপ্নে ভাবাও প্রায় দুঃসাধ্য ছিল খোদ কলকাতার বুকে। তবে একক উদ্যোগে এমনটাই করে দেখিয়েছিলেন এক বাঙালি তরুণ। অমূল্য কুমার ঘোষ (Amulya Kumar Ghosh)।
এটা যে-সময়ের কথা হচ্ছে, সেটা বিশ শতকের কুড়ির দশক। কলকাতায় শরীরচর্চা কিংবা ব্যায়াম প্রশিক্ষণকেন্দ্র যে নেই তেমনটা নয়। মধ্যগগনে ‘নিখিল বঙ্গীয় শরীরচর্চা সমিতি’। তাছাড়াও ইতিউতি গড়ে উঠেছে ‘যুবক সঙ্ঘ’-সহ আরও বেশ কিছু শরীরচর্চার বিদ্যালয়। তবে সেখানে কেবলমাত্র প্রবেশাধিকার পেতেন পুরুষরাই। অবশ্য মহিলাদের জন্যও এ-ধরনের পরিকাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে, তা হলফ করেই বুঝতে পেরেছিলেন তৎকালীন বাংলার ব্যায়াম বিশেষজ্ঞরা। সেই তালিকায় ছিলেন ক্যাপ্টেন জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাঃ হেমচন্দ্র রায়, পুলিনবিহারী দাস, রাজেন্দ্রনারায়ণ গুহঠাকুরতার মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। ডাক্তার, অধ্যাপক হেমচন্দ্র জানিয়েছিলেন, মহিলাদের শরীরচর্চার মূলস্রোতে না নিয়ে আসতে পারলে বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তবে তাঁদের জন্য ব্যায়ামচর্চার পরিকাঠামো গড়ে তুলতে কমপক্ষে ১ লক্ষ টাকার প্রয়োজন।
হেমচন্দ্রের এই কথা তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পরই রে-রে করে উঠেছিল সমাজ। মহিলারা ব্যায়াম শিখবে, তার জন্য আবার লক্ষ টাকার খরচ। হাসি-ঠাট্টার রব উঠেছিল গোটা শহরজুড়ে। কটূক্তি করতেও ছাড়েননি অনেকে। ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের বক্তব্য ছিল এরকম— “কেহ কেহ তাহার ওপর অগ্নিশর্মা হইয়া লড়াই করিতেও প্রস্তুত হইয়াছিল।”
মহিলাদের আদৌ শরীরচর্চার অধিকার পাওয়া উচিত কি উচিত নয়— তা নিয়েই যখন দ্বিবিভক্ত বাংলার সমাজ, সে-সময়ই কলকাতার তরুণীদের নিয়ে দুটি সংগঠন গড়ে তোলেন অমূল্য কুমার ঘোষ— ‘ছাত্রী সঙ্ঘ’ এবং ‘বালিকা ব্যায়াম-সমিতি’। না, শরীরচর্চার জন্য প্রকাণ্ড কোনো ভবন নেই, নেই দামি দামি সরঞ্জামও। হাতিয়ার বলতে অমূল্যকুমারের ব্যক্তিগত সংগ্রহের লাঠি, তরবারি, ছোরা। তাছাড়া বিভিন্ন যোগাসন, যুযুৎসু— এসব তো রয়েছেই। কখনও আবার সম্ভ্রান্ত পরিবারের অভিভাবকরা তাঁদের মেয়েদের জন্য কিনে দিতেন সাইকেল। সেটুকুই ছিল অমূল্যকুমারের সম্বল। খোলা মাঠেই এসবের প্রশিক্ষণ দিতেন অমূল্যকুমার।
কিন্তু কে এই অমূল্যকুমার? কীভাবেই বা কলকাতার শরীরচর্চার পরিমণ্ডলের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন তিনি? ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকার ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ১৭ শ্রাবণ সংখ্যা থেকে জানা যায়, অমূল্যর জন্য ১৯১০ সালের মে মাসে। কলকাতার বাসিন্দা নন তিনি। বরং, ১৯২৭ সালে ফরিদপুর থেকে কলকাতায় এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন অসিচালনা শেখার লোভেই।
আসলে কিশোর বয়সেই অমূল্যের হাতে আসে পুলিনবিহারী দাসের ‘লাঠি খেলা ও অসি শিক্ষা’ বইটি। সেই বই পড়ে নিজে নিজেই অস্ত্রচালনা শেখেন অমূল্য। কিন্তু বই পড়ে কি আর আশ মেটে? তাই স্বপ্নের মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে কলকাতায় চলে এসেছিলেন তিনি। বিফলে যায়নি তাঁর এই প্রয়াস। কেবলমাত্র গ্রন্থ পড়েই অসি ও লাঠিচালনায় তাঁর পারদর্শিতা দেখে মুগ্ধ হন লাঠিখেলোয়াড় পুলিনবিহারী। তিনি নিজেই প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন অমূল্যকে।
এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। কলকাতা তো বটেই, বাঁকুড়া, উত্তরবঙ্গ, আসাম-সহ একাধিক অঞ্চলেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় রীতিমতো নাম করেছিলেন অমূল্যকুমার। অসিচালনা, লাঠিচালনা, বর্শা ছোঁড়া কিংবা যুযুৎসুর মতো খেলা দেখিয়ে বেড়াতেন গোটা দেশজুড়ে। এমনকি ব্রিটিশ সাহেবদের সঙ্গে চ্যালেঞ্জ নিয়ে, তাঁদের ধরাশায়ী করেচেন তিনি, এমন কথারও উল্লেখ পাওয়া যায় ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকায়। তবে এসবের মধ্যেই তাঁকে ভাবিয়ে তুলেছিল শরীরচর্চার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়টি। আর সেখান থেকেই মহিলাদের নিয়ে বিশেষ সমিতি গড়ে তোলার উদ্যোগ। মাথার ওপর পুলিনবিহারীর আশীর্বাদও ছিল যে। ফলে এই স্বপ্নপূরণে অসুবিধা হয়নি খুব একটা। প্রথমে তাঁর ছাত্রীতালিকায় নাম লিখিয়েছিলেন সমাজের প্রভাবশালী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়েরা। তারপর ধীরে ধীরে সেখানে হাজির হন মধ্যবিত্তরাও।
তবে শুধুমাত্র মহিলামহলে যে শরীরচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি, এমনটা নয় একেবারেই। বরং, আর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন পুরুষদের মতোই বাঙালি মেয়েরাও হয়ে উঠুক স্বাবলম্বী। সমানাধিকারের জন্য তাঁরাও যেন সরব হন, চেয়েছিলেন অমূল্য। সফলও হয়েছিলেন তিনি।
১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাস সেটা। ঠিক করেন ছাত্রীদের নিয়ে সাইকেল অভিযানে বেরবেন অমূল্য। গন্তব্য ব্যারাকপুর, বালি হয়ে মগরা। সবমিলিয়ে প্রায় ৭৪ কিলোমিটারের পথ। অনেকে মুখ বাঁকিয়েছিলেন অমূল্যের ঘোষণায়। অনেকে দোনামনা করে তাঁর এই পাগলামিতে সামিল হতে দেননি নিজেদের কিশোরীকে। তবে হার মানেননি অমূল্য। সেদিন পাশে পেয়েছিলেন মাত্র ৩ জন ছাত্রীকে। তিনজনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র নারায়ণ গুহ ঠাকুরতার সন্তান— ঊষারাণী, আশারাণী, বেলারাণী। অমূল্যরতনের ‘ছাত্রীসঙ্ঘ’-এর অন্যতম শিক্ষার্থীদের তালিকায় এই তিন কিশোরীর নাম উঠে আসতে বাধ্য। শুধু সাইকেল চালিয়েই যে তাঁরা নজির গড়েছিলেন, এমনটা নয়। যুযুৎসু, লাঠি ও অসি খেলায় বাংলার বিভিন্নপ্রান্তে আয়োজিত প্রতিযোগিতায় একাধিক পদক সংগ্রহ করে এনেছিলেন রাজেন্দ্র নারায়ণের তিনকন্যা। নজর কেড়েছিলেন আভা দে, গীতা পাল, বিজলী মিত্ররাও। শুধু খেলোয়াড় হিসাবেই নয়, পরবর্তীতে তাঁদের অনেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও। সবমিলিয়ে বলতে গেলে শরীরচর্চাকে হাতিয়ার করে মহিলাদের মধ্যে এক জাগরণ তৈরি করেছিলেন অমূল্যকুমার ঘোষ। অথচ, এমন এক ব্যক্তিত্ব কতটুকুই বা মনে রাখতে পেরেছি আমরা? বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে তাঁর প্রতিভাবান ছাত্রীরাও, যাঁদের হাত ধরেই ভেঙেছিল বৈষম্যের বেড়াজাল…
তথ্যসূত্র :
'বঙ্গলক্ষ্মী' সচিত্র মাসিক পত্রিকা, দশম বর্ষ, অগ্রহায়ণ ১৩৪১ - কার্ত্তিক ১৩৪২, সম্পাদিকা - শ্রীহেমলতা দেবী
Powered by Froala Editor