দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের ২৯ বছর পরেও যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন এই ব্যক্তি!

সাল ১৯৭২। ফিলিপাইনসের লুবাং দ্বীপে পুলিশের গুলিতে নিহত হন একজন জাপানি সৈনিক। খবর পৌঁছায় জাপানেও। নানা তথ্য থেকে জানা যায়, তখনও আরেকজন জাপানি সৈনিক থেকে গিয়েছেন সেই দ্বীপে। অবশ্য ফিলিপাইনসের সঙ্গে তখন জাপানের বৈদেশিক সম্পর্ক বেশ ভালোই। এবং জাপান তখন ফিলিপাইনসে সেনা মোতায়েনও করেনি। কিন্তু জাপানি সৈনিকরা তবুও লড়ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের জন্য। হ্যাঁ, ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (World War II) থেমে যাওয়ার ২৭ বছর পরেও তাঁরা লড়ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয়ের জন্যই। এমনকি যে একক সৈনিক বেঁচে গিয়েছিলেন, পরবর্তী ২ বছর তিনি একাই লড়াই চালিয়ে যান।

তাঁর নাম হিরু ওনোদা (Hiroo Onoda)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ২৯ বছর পরেও যিনি যুদ্ধজয়ের লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেন এমন করেছিলেন তিনি? উত্তর পেতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে। ১৯৪৪ সালের ডিসেম্বর মাসে লুবাং দ্বীপে ছোট্ট একটি সেনাদল পাঠায় জাপান। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার সমস্ত মার্কিন বিমানপোত এবং সমুদ্রবন্দরগুলি ধ্বংস করে দেওয়া। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন ২০ বছরের সৈনিক হিরু ওনোদা। জাপ সেনাকর্তাদের কড়া নির্দেশ ছিল, যত বড়ো অঘটনই ঘটে যাক, যুদ্ধ ছেড়ে চলে আসা যাবে না। যুদ্ধ না জিতে ফিরে আসা যাবে না। সেই নির্দেশকে শিরোধার্য করেই এগিয়ে গিয়েছিলেন ওনোদা এবং তাঁর সঙ্গীরা।

তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। মার্কিন সেনাবাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে সহজেই পরাজিত হন তাঁরা। বহু সৈনিকের মৃত্যু হয়। শেষ পর্যন্ত ৪ জন সৈনিক পাহাড়ি উপত্যকায় আত্মগোপন করেন। যদিও লুবাং দ্বীপের আয়তন বেশি নয়। মাত্র ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৯ কিলোমিটার চওড়া দ্বীপ। তবে তার মধ্যেই রয়েছে ঘন বৃষ্টি অরণ্য। ফলে আত্মগোপন খুব কঠিন হয়নি। ৪ জনে পরিকল্পনা শুরু হয় সামান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়েই নতুন করে আক্রমণ শুরু করার। কারণ সেনাকর্তাদের নির্দেশ ছিল, যুদ্ধ না জিতে ফেরা যাবে না।

আত্মগোপন কঠিন ছিল না, কিন্তু জীবনধারণ সত্যিই কঠিন ছিল। সঙ্গে খাবারদাবার বিশেষ কিছু ছিল না। জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে থেকে ফলমূল যা জুটত, তাতেই খিদে মিটত তাঁদের। মাঝে মাঝে অবশ্য কিছু গরু গ্রাম ছেড়ে এসে পড়ত জঙ্গলের মধ্যে। তখন তার মাংস পুড়িয়ে খাওয়া হত। এভাবেই চলছিল। ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাস নাগাদ নতুন করে আক্রমণের পরিকল্পনাও নিয়ে নিলেন তাঁরা। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই হেলিকপ্টার মারফত এসে পৌঁছলো একটি বিজ্ঞপ্তি। মার্কিন সেনাবিভাগ জানিয়েছে, গত আগস্ট মাসেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। অতএব তাঁরা যেন এবার আত্মসমর্পণ করেন।

আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্কিনিদের গোপন হাতিয়ার ‘বাদুড় বোমা’

১৯৪৫-এর আগস্টে সত্যিই শেষ হয়ে গিয়েছিল বিশ্বযুদ্ধ। কিন্তু ওনোদার মনে হয়, এটা ধূর্ত মার্কিন সেনাদের একটি ছক মাত্র। তাই যথারীতি অক্টোবর মাসে নতুন করে বন্দর এবং গ্রামাঞ্চলে আক্রমণ চালান তাঁরা। এই আক্রমণের খবর পৌঁছায় জাপানেও। জাপ সেনাবাহিনী থেকেও হেলিকপ্টার মারফত খবর পাঠানো হয়। কিন্তু সেই খবরও বিশ্বাস করেন না ওনোদা। এটাকেও মার্কিন সেনাদের চাল বলেই উড়িয়ে দেন। নতুন করে যুদ্ধের প্রস্তুতিও চলে।

আরও পড়ুন
পেশা নাৎসি-শিকার, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন বাস্তব ‘অ্যাভেঞ্জার’-রা

১৯৫৪ সাল নাগাদ দলের দুজন সদস্য মারা যান বিষাক্ত ফল খেয়ে। ওনোদা এবং তাঁর আরেক সঙ্গী কোজুকা থেকে যান। ১৯৭২ সালে আবার গ্রাম আক্রমণ করতে গিয়ে মারা যান কোজুকা। ফিলিপাইনস সরকার মনে করেছিল ওনোদাও আগেই মারা গিয়েছেন। কিন্তু গ্রামবাসীরা জানান, কোজুকার সঙ্গে আরও একজন ছিলেন। অতএব বোঝা যায়, ওনোদা তখনও বেঁচেই আছেন। ২ বছর অনুসন্ধানের পর এক জাপানি গবেষক নোরিয়া সুজুকি তাঁর সন্ধান পান। সুজুকি জানান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিবৃত্ত। এও জানান, জাপান সেই যুদ্ধ হেরে গিয়েছে। কিন্তু সেদিনও তাঁর কথা বিশ্বাস করেননি ওনোদা। তিনি জানান, তাঁর সামনে এসে তাঁর সময়ের কোনো সেনাপ্রধান যদি এই কথা জানান, একমাত্র তাহলেই তিনি বিশ্বাস করতে পারেন।

আরও পড়ুন
মাটির তলায় আস্ত ‘দুর্গ’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল লন্ডনের এই বাঙ্কার

অবশেষে ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ মেজর তানিগুচিকে পাঠানো হয় ফিলিপাইনসে। তিনিই ওনোদাকে জাপানে ফিরিয়ে আনেন। ওনোদাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানও জানানও হয়। তাঁকে যুদ্ধের শ্রেষ্ঠ বীরের মর্যাদাও দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি কোনো সম্মানই গ্রহণ করতে রাজি হননি। জাপান যে যুদ্ধে হেরে গিয়েছে, এ-কথা তিনি তখনও মানতে পারেননি। তেমনই মানতে পারেননি যুদ্ধপরবর্তী গণতান্ত্রিক জাপানের ব্যবস্থাও। তাঁর মনের মধ্যে তখনও চলছিল বিশ্বযুদ্ধ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More