হাঁটাতেই লুকিয়ে সমাধান, মানসিক চাপ ও অবসাদের সঙ্গে লড়তে অভিনব ক্লাব ব্রিটেনে

লন্ডনের মূল কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরত্ব কয়েক মাইল। মানুষের কোলাহল নেই সেখানে, নেই শহরের ক্যাকাফোনি। দু’দিকে ছড়িয়ে রয়েছে গলফের মাঠ আর ছোটো বড়ো খামার। তার মাঝখান দিয়েই চলে গেছে একফালি রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে হাঁটছেন জনা কুড়ি মানুষ। কখনও গাছের ছায়ায় গোল হয়ে বসে গল্প করছেন নিজেরা। তারপর আবার হাঁটা। না, এঁরা স্থানীয় বাসিন্দা নন কেউ। নন পর্যটকও। তবে কোথায় চলেছেন তাঁরা?

নিছক ঘুরতে বেরিয়ে পড়া কিংবা নতুন কিছু এক্সপ্লোর করতে নয়, মানসিক চাপ, অবসাদ কিংবা উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই করতেই এই মাইলের পর মাইল হন্টন। দক্ষিণ লন্ডনে গেলেই দেখা মিলবে এমনই এক অভিনব হাঁটার ক্লাবের (Walking Club)। ‘প্রপার ব্লোকস ক্লাব’ (Proper Blokes Club)। লন্ডনের (London) ৩৫ বছর বয়সি কমিউনিটি স্পোর্টস কোচ স্কট ওটন-জনসনের হাত ধরে ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিশেষ ক্লাবটি। তারপর প্রায় কয়েকশো মানুষকে নতুন করে দিশা দেখিয়েছে এই সংগঠন। সচেতন করেছে মানসিক স্বাস্থ্য (Mental Health) সম্পর্কে। লড়তে শিখিয়েছে অবসাদ কিংবা মানসিক চাপের মতো বিষয়গুলির সঙ্গে। 

আজ থেকে দশ বছর আগের কথা। বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছিল স্কটের। তবে সেখানেই থেমে থাকেনি বিষয়টি। সন্তান কার কাছে থাকবে— তা নিয়ে আদালতে দীর্ঘদিন ধরে লড়াই চলেছিল স্কটের। এসবের মধ্যেই নিজের কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছিল তাঁকে। নিজের দৈনন্দিন জীবনকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে বুঝতে পেরেছিলেন, এই লড়াই তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছে ভেতর থেকে। ক্রমশ উদ্বেগ ও অবসাদের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন তিনি। 

সেটা ২০১৭ সালের কথা। বাধ্য হয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন থেরাপিস্টের কাছে। বেশ কিছুদিন চলেছিল চিকিৎসা, কাউন্সিলিং। সে-সময় থেরাপিস্টের কাছ থেকে ফেরার পথে বাস কিংবা ট্যাক্সি নিতেন না স্কট। বরং, কয়েক মাইল পথ হেঁটেই বাড়ি ফিরতেন তিনি। তাঁর কথায়, এই মুহূর্তটাই ছিল তাঁর কাছে সবচেয়ে বেশি আনন্দের বা স্বস্তির। সেখান থেকেই এই ক্লাব প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা শুরু করেন তিনি। 

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলে সে-কথা প্রকাশ্যে লেখেনও স্কটি। লন্ডনের অন্যান্য বাসিন্দারা, যাঁরা মানসিক সমস্যায় ভুগছে, তাঁদের কাছে তিনি আবেদন জানান, তাঁর সঙ্গে হাঁটায় যোগ দিতে। তবে আশা করেননি আদৌ সাড়া পাবেন তিনি। পরদিন অবাক করে দিয়েই, এক ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে হাজির হন তাঁর বাড়িতে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে সংখ্যাটা। 

এই ক্লাবের সদস্যদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এক আস্ত পরিবার। প্রতি সপ্তাহে যেমন ব্রিটেনের বিভিন্ন নির্জন প্রান্তে হাঁটার আয়োজন করে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ক্লাব। তেমনই হাঁটার মাঝেই প্রত্যেকে অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেন নিজের অবসাদের কথা। তবে এই ক্লাবের সদস্য হওয়ার শর্ত নেই কোনো। যে-কেউ বিনামূল্যেই যোগদান করতে পারেন এই ক্লাবে। 

স্কটের বক্তব্য, ক্রমশ একাকীত্বের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে মানুষ। কমে আসছে পারস্পরিক যোগাযোগ। আর তার কারণেই মানসিক অবসাদের শিকার হচ্ছেন মানুষ। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি ৫ জন মানুষের মধ্যে ১ জন কোনো না কোনো মানসিক অসুস্থতায় ভুগছেন। লকডাউন আর ত্বরান্বিত করেছে এই পরিস্থিতিকে। আর সেই কারণেই এই ক্লাবের গুরুত্ব বর্তমান সময়ে অপরিসীম। এমনটাই মনে করছেন ‘প্রপার ব্লোকস ক্লাব’-এর প্রতিষ্ঠাতা স্কট। হাঁটার মধ্যে দিয়েই অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু গড়ে তুলছেন তিনি। কোনোরকম রাগ, বিরক্তি ছাড়া অন্যের কথা শোনা এবং নিজেকে আত্মপ্রকাশ করার অভ্যেস গড়ে তুলতে পারলেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে মানসিক অসুখ কিংবা আত্মহত্যার মতো ঘটনাকে, বিশ্বাস স্কটের…

Powered by Froala Editor

More From Author See More