১৯৮৫ সাল। আরএমএস টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের দাবি করেন এক মার্কিন গবেষক। অথচ, ধ্বংসাবশেষের অবস্থান কিংবা ছবি— স্পষ্টভাবে কোনো তথ্যই প্রকাশ করেননি তিনি। সে-সময় বিতর্কও কম হয়নি তাঁর এই দাবি নিয়ে। তবে ১৯৮৬ সালে প্রমাণ-সহ বিস্তারিত প্রবন্ধ প্রকাশ করেন তিনি। এমনকি প্রথমবারের জন্য সামনে আসে, টাইটানিক শুধু ডুবেই যায়নি, বরং দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল হিমশৈলের আঘাতে।
রবার্ট বালার্ড (Robert Ballard)। হ্যাঁ, টাইটানিকের ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কৃত হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (US) এই সমুদ্র-বিজ্ঞানীর সৌজন্যেই। তবে তাঁর কৃতিত্ব এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং, আধুনিক সমুদ্র-বিজ্ঞান (Oceanology) ও সমুদ্র বিষয়ক গবেষণায় বিপ্লব এনেছিলেন রবার্ট এবং তাঁর তৈরি প্রযুক্তি।
রবার্টের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ক্যালিফোর্নিয়ায়। শৈশব থেকেই তাঁকে আকর্ষণ করত জুলে ভার্নের উপন্যাস। বিশেষত ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’-র ক্যাপ্টেন নিমোই হয়ে উঠেছিল ভার্নের আদর্শ। সবমিলিয়ে বলতে গেলে শৈশব থেকেই সমুদ্র এবং অভিযান নিয়েই স্বপ্ন দেখতেন রবার্ট। কাজেই পড়াশোনার বিষয় হিসাবেও পরবর্তীতে ওশানোলগ্রাফিকেই বেছে নেন তিনি। যদিও কেমিস্ট্রি ও জিওলজি নিয়েই স্নাতকস্তরে পড়াশোনা রবার্টের।
রবার্টের বাবা ছিলেন নর্থ আমেরিকান অ্যাভিয়েশনের ইঞ্জিনিয়ার। সেই সূত্রেই ১৯৬২ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই একটি বিশেষ প্রকল্পে পার্ট-টাইম কাজ পান রবার্ট। আসলে সে-সময় এক বিশেষ ধরনের সাবমেরিন তৈরির কাজ চলছিল নর্থ আমেরিকান অ্যাভিয়েশনে। যা কিনা সাধারণ সাবমেরিনের থেকে আকার, আয়তনে ছোটো অথচ সমুদ্রগর্ভে লুকিয়ে থাকা জাহাজের মৃতদেহের অবস্থান খুঁজে বার করতে সক্ষম। কিন্তু কী এমন গুরুত্বপূর্ণ গোপন জিনিস খুঁজতে প্রয়োজন হল এমন আশ্চর্য যানের?
আসলে ৬০-এর দশকের শুরুতেই আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গিয়েছিল দুটি পরমাণুশক্তি-চালিত মার্কিন সাবমেরিন। ইউএসএস স্করপিয়ন এবং থ্রেশার-খ্যাত এই দুই সাবমেরিনের ‘মৃতদেহ’ খুঁজে বার করতেই এই বিশেষ সাবমেরিন তৈরির হুকুম দিয়েছিল মার্কিন সরকার। তবে নর্থ আমেরিকান অ্যাভিয়েশনের এই প্রকল্প শেষমেশ ব্যর্থ হয়। তবে হাল ছাড়েননি রবার্ট। বলতে গেলে, হাতের মুঠোয় চাঁদ পেয়েছিলেন তিনি। স্নাতকতা শেষ করার পর এই আশ্চর্য যন্ত্র তৈরি করে গবেষণা চালিয়ে যান তিনি। শেষ পর্যন্ত উডস হোল ওশিয়ানোগ্রাফিক ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনার সময় ‘অ্যালভিন’ (Alvin) নামের এই বিশেষ সাবমেরিনটি তৈরি করে ফেলেন তিনি।
১৯৮৫ সালেই ‘স্করপিয়ন’ এবং ‘থ্রেশার’-এর খোঁজে আটলান্টিকে নেমেছিল অ্যালভিন। সে-সময় কাজের ফাঁকে অ্যালভিনে চেপে সমুদ্রের তলদেশের ভূ-প্রকৃতি দেখে বেড়াতেন রবার্ট। সেই সূত্রেই আকস্মিকভাবে টাইটানিক আবিষ্কার। তবে ডঃ রবার্ট ও তাঁর ‘অ্যালভিন’-এর গুরুত্ব এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। এই যন্ত্রের সাহায্যেই একাধিক সামুদ্রিক রহস্যের সমাধান করেছেন তিনি। ব্ল্যাক সি বা কৃষ্ণসাগরের জলে কাঠ পচনের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার অনুসন্ধান, সমুদ্রের তলদেশের রাসায়নিক নমুনার বিশ্লেষণ, ট্রেনের ভূ-প্রকৃতি, আটলান্টিকে লুকিয়ে থাকা আশ্চর্য বাস্তুতন্ত্র, নতুন প্রজাতি কিংবা প্রাগৈতিহাসিক হাঙরের জীবাশ্মের অনুসন্ধান—বিগত তিন দশকে তাঁর হাত ধরেই বদলে গিয়েছিল সমুদ্র গবেষণার রূপরেখা।
আশ্চর্যের বিষয় হল, আজও সমুদ্র গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে অ্যালভিন। তাছাড়া বর্তমানে সমুদ্রতলের ম্যাপ তৈরির জন্য যে অত্যাধুনিক সোনার প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, তাও রবার্ট নির্মিত ‘অ্যালভিন’-এর ওপর ভিত্তি করেই। চলতি বছরেই ৮০ বছরে পা দিয়েছেন ডঃ রবার্ট বালার্ড। স্বাভাবিকভাবেই বয়সের ভারে ফুরিয়েছে তাঁর অভিযান-স্পৃহা। তবু আজও অভিভাবকের মতোই তরুণ সমুদ্র-গবেষকদের পথ দেখাচ্ছেন বাস্তবের ক্যাপ্টেন নিমো…
Powered by Froala Editor