পাথরবন্দি হারিয়ে যাওয়া সময়কে ‘উদ্ধার’ করেছিলেন যে ব্যক্তি

পড়াশোনা করেছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানে। অথচ, গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করলেও, তাঁর প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। আবার প্রিয় বিষয় হল গণিত, রসায়ন এবং ভূগোল। সবমিলিয়ে বলতে গেলে এক বর্ণময় চরিত্র। জেমস হাটন। না, সচরাচর এই নামটার সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নই আমরা কেউ-ই। অথচ, স্কটল্যান্ডের প্রান্তিক অঞ্চলে বেড়ে ওঠা এই মধ্যবিত্ত ব্যক্তিই খুলে দিয়েছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসচর্চার এক অনন্য বিষয়— ভূতত্ত্ববিদ্যা বা জিওলজি (Geology)। আর আধুনিক ভূতত্ত্ববিদ্যার জনক হিসাবেই পরিচিত গবেষক জেমস হাটন (James Hutton)। 

হাটনের আশ্চর্য আবিষ্কারের গল্পে না হয় ফিরে যাওয়া যাবে আবার। আপাতত ঘুরে আসা যাক স্কটল্যান্ডের পূর্ব উপকূলের বারউইকশায়ারে। সমুদ্রের গা ঘেঁষেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শিলাখণ্ড। তার মাথার ওপর সবুজ বিস্তৃত তৃণভূমি। বলতে গেলে ভ্রমণ-পিপাসুদের কাছে এ এক স্বর্গরাজ্য। তবে শুধু পর্যটকরাই নয়, প্রতিবছর এই অঞ্চলে গবেষণার জন্য ভিড় জমান হাজার হাজার ভূতত্ত্ববিদ। 

বারউইকশায়ারের মধ্যেই রয়েছে ছোট্ট একটি পাথুরে অঞ্চল— ‘সিকার পয়েন্ট’। মজার বিষয় হল, এই সিকার পয়েন্টেই জন্ম নিয়েছিল আধুনিক ভূতত্ত্ববিদ্যা। সেবার সেই ইতিহাসেই ফিরে যাওয়া যাক বরং। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় সেটা। বারউইকশায়ারে নিছকই বেড়াতে গিয়েছিলেন জেমস। সে-সময়ই আশ্চর্য এই পাথরগুলোর গঠন নজর কাড়ে তাঁর। কিন্তু কেন?

সামুদ্রিক শিলা বা পাললিক শিলা তৈরি হয় একের পর এক পলির আস্তরণ পড়ে পড়ে। পলির স্তরের সংখ্যা থেকেই বোঝা যায় সংশ্লিষ্ট পাথরের বয়স। সাধারণত এই ধরনের শিলা পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালভাবেই তৈরি হয়। কিন্তু স্কটল্যান্ডের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খানিকটা আলাদা। সেখানকার দৈত্যাকার পাথরগুলোর গঠন বেশ অদ্ভুত। পাথরগুলি পুরোটাই যে পাললিক শিলা দিয়ে গঠিত তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে আশ্চর্যের বিষয়, এসব পাললিক শিলার নিচের অংশে শিলাস্তরগুলি পৃথিবীর ভূত্বকের সঙ্গে প্রায় লম্বভাবে অবস্থিত। আবার উপরের দিকে সেগুলি সমান্তরাল পৃথিবীপৃষ্ঠের সঙ্গে। 

এই আশ্চর্য বৈসাদৃশ্যই ভাবিয়ে তুলেছিল তাঁকে। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অধ্যাপককে নিয়ে বিশেষ দল তৈরি করেছিলেন তিনি। তারপর বিস্তারিত গবেষণা চালিয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের উপকূল ধরে। তাতে স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে তত্ত্বের মধ্যে দিয়েই এই সমস্যার সমাধান করেছিলেন হাটন। তৈরি করেছিলেন বিশেষ মডেল। 

তাঁর মডেল অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে উলম্ব শিলাস্তরগুলিও আসলে ভূত্বকেরই সমান্তরাল ছিল। পরবর্তীতে পৃথিবীর টেকটোনিক পাতের চলাচলে সেগুলি ভাঁজ হয়ে উপরে উঠতে থাকা ধীরে ধীরে। অনেকটা সমুদ্রের ঢেউ যেমন হয় তেমনই। অবশ্য সে-সময়ে টেকটোনিক প্লেটের বদলে মহাদেশীয় পরিচলন বলেই এই ঘটনাকে চিহ্নিত করেছিলেন হাটন। সিকার পয়েন্টের উলম্ব শিলাগুলির নেপথ্যে রয়েছে এ-ধরনের পাথর। আবার এর ঠিক উপরে যে পাথরগুলির স্তর পৃথিবীর ভূতলের সঙ্গে সমান্তরাল, সেগুলোর জন্ম হয়েছে এই ঘটনার বহু কোটি বছর পর। আর সেই কারণেই, উলম্ব শিলাখণ্ডগুলির উপরের সূচাগ্র অংশ ক্ষয় পেয়েছে মধ্যবর্তী সময়ে, হয়ে উঠেছে সমতল। অর্থাৎ, স্পষ্টতই এই দুই ঘটনার মধ্যবর্তী সময়ে কোনো বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা ঘটনার জন্য ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল পৃথিবী। 

মজার বিষয় হল, আজকের অত্যাধুনিক যন্ত্র এবং সমীক্ষা মান্যতা দেয় হাটনের এই তত্ত্বকেই। কোনোরকম প্রযুক্তি, যন্ত্র, উপযুক্ত গাণিতিক সমীকরণের অভাব থাকা সত্ত্বেও আড়াইশো বছর আগে কীভাবে এই রহস্যের সমাধান করেছিলেন স্কটিশ বিজ্ঞানী— তা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হতে হয় বৈকি। তবে শুধু হাটনই নয়, সিকার পয়েন্টের সঙ্গে জড়িয়ে আরও এক কিংবদন্তি গবেষক ডারউইনও। তিনিও হাটনের গবেষণাপত্র পড়ে হাজির হয়েছিলেন স্কটল্যান্ডের এই প্রান্তরে। বিবর্তনের তত্ত্ব প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও এই ‘হারিয়ে যাওয়া সময়’ অর্থাৎ মধ্যবর্তী ‘ধ্বংস-কাল’ বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল তাঁকে। সবমিলিয়ে এক আশ্চর্য ইতিহাস নিয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে স্কটল্যান্ডের এই রহস্যময় প্রান্তর… 

Powered by Froala Editor