১৯৮৬ সাল। ইতালি, উরুগুয়ে, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম এবং পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ তুলেছিল আর্জেন্টিনা। শুরু হয়েছিল মারাদোনা-যুগ (Maradona)। তারপর পেরিয়ে গেছে ৩৬টা বছর এখনও পর্যন্ত বিশ্বকাপ-খরা কাটেনি এএফএ-র। তবে চলতি বছরে মারাদোনার পদাঙ্ক অনুসরণ করেই লিও মেসি (Messi) নীল-সাদা ব্রিগেডকে (Argentina) পৌঁছে দিয়েছেন ফাইনালে। বাঁচিয়ে রেখেছেন বিশ্বজয়ের স্বপ্ন। তবে মজার বিষয় হল, এই দুই আর্জেন্টাইন সুপারস্টারকেই প্রশিক্ষণ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল একজন কোচের।
আলফিও বাসিলে (Alfio Basile)। ফুটবলের ইতিহাসে এক বিস্মৃতপ্রায় নাম। তাঁকে আর্জেন্টিনার স্বর্ণযুগের শেষ কোচ বললেও ভুল হয় না এতটুকু। বিশ্বমঞ্চে বাসিলের উত্থান হয়েছিল, ১৯৯০-এর বিশ্বকাপের পর। ইতালির বিশ্বকাপে সেবার টেনেটুনে ফাইনালে উঠলেও, শেষ অবধি জার্মানির কাছে ১-০ গোলে পরাজিত হয় মারাদোনা-খচিত আর্জেন্টিনা।
না, এই হার দলের ফুটবলারদের ব্যর্থতা নয়, বরং আর্জেন্টাইন কোচের ভুল স্ট্র্যাটেজি এবং ট্যাকটিক্সই ‘কাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল দলের ক্ষেত্রে। বহু মানুষই বিশ্বাস করে এমনটা। সে-সময় আর্জেন্টিনা দলের দায়িত্ব কার্লোস বিলার্দোর হাতে। ১৯৯০-এর বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নের তকমা ধরে রাখতে অতিরিক্ত রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলার দিকে ঝুঁকেছিলেন তিনি। গোটা টুর্নামেন্টের পরিসংখ্যান দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যায় তা। সবমিলিয়ে ৭ ম্যাচে ২২টি হলুদ কার্ড দেখতে হয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। ফাইনালেও অব্যাহত ছিল এই ধারা। সেইসঙ্গে ২টি লাল কার্ড। ৮৫ মিনিট গোলশূন্য থাকলেও, শেষ মুহূর্তে আর্জেন্টিনা পেনাল্টি দিয়ে বসে পশ্চিম জার্মানিকে। আর সেখান থেকেই গোল হজম করতে হয় গোয়কোচিয়াকে।
আর্জেন্টিনার এই হারের পরই চাকরি যায় বিলার্দোর। শুরু হয় নতুন ফুটবল কোচের সন্ধান। তৎকালীন সময়ে আর্জেন্টিনার ঘরোয়া লিগে রীতিমতো নজর কেড়েছিল বাসিলের স্ট্র্যাটেজি। ১৯৭৮-এর বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন কোচ সিজার মেনোত্তির খেলার ধরনের সঙ্গে যথেষ্ট মিল ছিল তাঁর ছকের। ফলে, স্বাভাবিকভাবেই এএফএ-র নজর পড়ে তাঁর দিকে।
১৯৯১ সালে বাসিলে যখন দলের দায়িত্ব নন, তখন রীতিমতো শোচনীয় অবস্থা আর্জেন্টাইন স্কোয়াডের। বিলার্দোর কোচিং-এ রক্ষণাত্মক ফুটবলে ততদিনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়রা। সেইসঙ্গে দেশের প্রধান তারকা মারাদোনা ডোপিং টেস্টে ধরা পড়ে ১৫ মাসের জন্য ফুটবল জগত থেকে নির্বাসিত। সবমিলিয়ে পরিস্থিতিটা ছিল বিভীষিকার মতোই।
এইসময় দলের দায়িত্ব নিয়ে নতুন তারকার অনুসন্ধানে নামেন বাসিলে। তুলে আনেন দিয়েগো সিমিওনে, লাতারে, লিওনার্দো রদ্রিগেজদের। সেইসঙ্গে বাতিস্তুতা কিংবা গোয়েকোচিয়ার মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা তো ছিলেনই। সবমিলিয়ে বাসিলের এই নতুন আর্জেন্টিনা ছন্দময় ফুটবল দিয়েই শুরু করেছিল জয়যাত্রা। প্রথম ম্যাচেই হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে ২-০ গোলের সহজ জয় তুলে নেন আর্জেন্টাইন কোচ। সে-বছরে আর্জেন্টিনাকে ১৩তম কোপা আমেরিকাও এনে দেন তিনি। তারওপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে ৩-২ গোলে আর্জেন্টিনা হারিয়েছিল প্রথম ম্যাচেই।
এখানেই শেষ নয়। ১৯৯১ থেকে টানা ২ বছর জয়যাত্রা বজায় রেখেছিল বাসিলের আর্জেন্টিনা। ’৯২-এর কনফেডারেশন কাপ, ’৯১ ও ’৯৩-এর কোপা আমেরিকা-সহ জিতেছিল একাধিক আন্তর্জাতিক প্রীতি টুর্নামেন্টও। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বজয়ের আশাও ছিল প্রবল। তবে ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপের আগেই ফের ছন্দ হারায় আর্জেন্টিনা। মারাদোনা মাঠে ফিরে এলেও, প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল ফিটনেসের অভাবে। সেইসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে ড্র ও হারের কারণে সমর্থকরা সন্দিহান হয়ে উঠেছিল বাসিলের ওপরেও।
তবে সবচেয়ে বড়ো ধাক্কা আসে ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ে। প্রথম দুটি ম্যাচেই সহজ জয় তুলে নিয়েছিল আর্জেন্টাইনরা। মারাদোনাকেও দেখা গিয়েছিল তাঁর চিরাচরিত ফর্মে। তবে তারপরেই ফের ডোপিং টেস্টে ধরা পড়েন তিনি। বাদ যান জাতীয় দল থেকে। ফিরে যেতে হয় দেশে। অন্যদিকে চোট পান ক্যানিজিয়া। সবমিলিয়ে আক্রমণের দুই প্রধান গুটি হারান বাসিলে। ফলত, রাউন্ড অফ ১৬-তে ধারে-ভারে পিছিয়ে থাকা রোমানিয়ার কাছে হারতে হয় বাসিলের দলকে।
এখানেই ইতি পড়ে তাঁর প্রথম অধ্যায়ের। এর ১২ বছর পর ফের আর্জেন্টিনার জাতীয় দলে প্রত্যাবর্তন করেন প্রবীণ কোচ। ২০০৬-এ বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর ফের ডাক পড়েছিল তাঁর। সে-সময় আর্জেন্টিনা উত্থান দেখছে এক নতুন তারকার। লিও মেসি। লিও মেসিকে কেন্দ্র করেই আক্রমণের গুটি সাজিয়েছিলেন বাসিলে। এমনকি মেসি ছিলেন তাঁর প্রিয় শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম।
তবে এতকিছুর পরেও দ্বিতীয় অধ্যায়টি খুব একটা সুখকর হয়নি বাসিলের। এই দু’বছরে আর্জেন্টিনা একটিও ট্রফি এনে দিতে পারেননি তিনি। ব্রাজিলের কাছে হাতছাড়া হয়েছিল কোপা আমেরিকার ট্রফি। পাশাপাশি ড্র এবং হারের ধারাও অব্যাহত ছিল। যার ফল স্বরূপ ২০০৮ সালেই চাকরি যায় বাসিলের। অবশ্য তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন মারাদোনা পরবর্তী সময়ে ফের স্বর্ণযুগ আনতে পারে তরুণ তারকা লিওনেল। দলকে চূড়ান্ত সাফল্য এনে দিতে না পারলেও, এই জায়গায় যে এতটুকু ভুল ছিলেন না আলফিও বাসিলে, ফুটবলপ্রেমীরা তার প্রমাণ পেয়েছে বিগত কয়েক বছর ধরেই…
Powered by Froala Editor