দেশের বাইরে না-গিয়েই বিশ্বভ্রমণ, বিভূতিভূষণের সঙ্গে মিলে যায় কিউবার কুলি-কবির গল্প

কিউবা বলতেই প্রথমে ভেসে ওঠে হাভানার ছবি। তবে হাভানার মতো জনপ্রিয় না হলেও ছোট্ট ত্রিনিদাদ এক প্রাণবন্ত শহর কিউবার। ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সঙ্গে এই শহরকে গুলিয়ে ফেলেন অনেকেই। ৫০০ বছরের বেশি পুরনো ইউনেস্কোর ঐতিহ্যবাহী শহরের তকমা পাওয়া এই ঔপনিবেশিক শহর আশ্চর্য স্থাপত্যে ভরপুর। ১৮ ও ১৯ শতকের তৈরি প্যাস্টেল রঙে মোড়া বাড়িগুলি আজও গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতোই।

এই শহরের মেয়র প্লাজা থেকে বেরিয়ে ল্যাম্পপোস্ট সাজানো রাস্তা ধরে মূল বাসস্টপে পৌঁছে গেলে দেখা মিলবে কুলিদের। কেউ ব্যস্ত তখন কাজে, আবার কেউ অপেক্ষারত অর্ডারের জন্য। খানিকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেই এক ব্যক্তির উপস্থিতি সেখানে চোখে পড়তে বাধ্য। কাজ সেরেই যিনি দ্রুত এসে বসে পড়েন ঠেলাগাড়িতে। দু’হাতের ফাঁকে মেলে ধরেন নোটবুক কিংবা বই। লুইস মার্টিনেজ। পেশায় কুলি বা পোর্টার হলেও, নেশায় লুইস একজন খাঁটি কবি। যিনি ঘুরে ফেলেছেন সারা বিশ্বই।

শুনতে অবাক লাগছে? বেশ তো, পরীক্ষা করেই দেখুন না। তাজমহলের অবস্থান, বয়স, পর্যটকদের জন্য প্রদর্শনের সময় কিংবা নরওয়েতে নর্দার্ন লাইট দেখতে ঠিক কোন সময়ে কোন শহরে গেলে শ্রেয় হয়— এসব প্রশ্ন নিঃসন্দেহে করতে পারেন মার্টিনেজকে। এতটুকু হতাশ না করেই, নিজের সমস্ত অভিজ্ঞতা ঢেলে উত্তর দেবেন তিনি।

প্রায় ৩০০০-এর বেশি কবিতা লিখেছেন মার্টিনেজ। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল প্রতিটি কবিতার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে তাঁর এই ভ্রমণ-পিপাসা। প্রতিটি কবিতাই আসলে কোনো দেশের কোনো বিশেষ শহরের বর্ণনা দিয়েই নির্মাণ করেছেন তিনি। সেই শহরকে দেখেছেন, দেখিয়েছেন নিজের চোখে। একদম নির্ভুল, বিশদ, ছবির মতো সে বিবরণ।

এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। তারপর নয় আবার ফেরা যাবে মার্টিনেজের কথায়। ১৯৬১ সাল। কিউবান বিপ্লব সফল হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে প্রায় ২ বছর। কিন্তু টালবাহানা চলছেই দেশের পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ উল্লেখযোগ্য অবস্থান এবং প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এই দ্বীপরাষ্ট্রকে মুষ্ঠিগত করতে মুখিয়ে হয়ে রয়েছে মার্কিন প্রশাসন। টোপ দিয়ে রেখেছে পুঁজিবাদের। 

কমিউনিস্ট মনোভাবের এই সদ্য জন্মানো দেশে একবার যদি সেই পুঁজিবাদ ক্ষমতা কায়েম করে তবে শেষ সবকিছুই। এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন রাষ্ট্রনেতা। ফিদেল কাস্ত্রো দেখলেন দেশের মানুষ বাইরের দেশে পরিযায়ী বা প্রবাসী হয়ে চলে গেলে নতুন দেশের অর্থনীতি স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারবে না। আর ভ্রমণের মাধ্যমেও যদি নাগরিকরা বৈশ্বিক বাজারের সুযোগ-সুবিধার সন্ধান পান, তাহলে জেগে উঠবে সেখানে গিয়ে উপার্জনের বাসনা। সে জন্যই ১৯৬১ সালে তিনি নিষিদ্ধ করলেন বিদেশভ্রমণ। তবে দেশের আয়ের কথা ভেবেই বিদেশি পর্যটকদের জন্য খোলা রাখলেন পথ।

আরও পড়ুন
গানের সূত্রে ঢুকে পড়বে পশ্চিমি পুঁজিবাদ; কিউবায় লেননকে নিষিদ্ধ করলেন ফিদেল কাস্ত্রো

প্রায় ৫০ বছরেরও বেশি সময় কিউবায় কায়েম ছিল এই নিষেধাজ্ঞা। ২০১৩ সালে এই বিধিকে শিথিল করেন ফিদেল কাস্ত্রোর পরবর্তী শাসক, তাঁর ভাই রাউল কাস্ত্রো। অবশ্য বিদেশ ভ্রমণে ইচ্ছুক নাগরিকদের অনুমতি নিতে হয় দেশের প্রশাসনের থেকে। তবে দেওয়া হয় পাসপোর্ট।  

এবার নিশ্চয়ই আপনার মনেও ফিরে এসেছে প্রশ্নটা? হ্যাঁ, ঠিকই তো। যদি নিষিদ্ধই হয় বিদেশভ্রমণ তবে কীভাবে সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়ালেন মার্টিনেজ? প্রকৃতপক্ষে কিউবার বাইরে পা দেননি তিনি। তবে সারা পৃথিবীকে দেখেছেন পর্যটকদের চোখ দিয়েই। ত্রিনিদাদ বাসস্টপে একজন কুলি হিসাবে কাজ করার সময় সমস্ত পর্যটকদের সঙ্গেই অদ্ভুত সম্পর্ক গড়ে তোলেন মার্টিনেজ। তারপর তাঁদের থেকে ধীরে ধীরে জানতে থাকেন সেসব দেশের বিবরণ। সম্ভব হলে সংগ্রহ করেন ছবিও।

আর তাছাড়াও একাধিক বই তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী। যার মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি অ্যাটলাস। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের ওপর আলাদা আলাদা করে লিখিত সেই খণ্ডগুলির অধ্যায়ন ছাড়া কখনোই ঘুম আসে না মার্টিনেজের চোখে। সীমানা তাঁকে বন্দি করে রাখলেও মানসচক্ষে কাল্পনিক পর্যটক হয়েই তিনি দাপিয়ে বেড়ান সারা পৃথিবী। 

আরও পড়ুন
কিউবার ডাক্তারদের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়ার প্রস্তাব ইতালির

বিগত ২০ বছর ধরে এই বাসস্টপেই কুলির কাজ করে চলেছেন তিনি। তবে এই নেশা তারও আগে থেকে। তখন শুধু সঙ্গী ছিল অ্যাটলাস। আর আজ বিদেশের বিভিন্ন বন্ধুদের পেয়েছেন তিনি নিজের অন্বেষণের সঙ্গী হিসাবে। বদল শুধু এইটুকুরই। মার্টিনেজ যখন শিশু তখন থেকেই কিউবায় নিষিদ্ধ হয় বিদেশ ভ্রমণ। আজ সেই নিষেধাজ্ঞা আংশিকভাবে উঠে গেলেও মার্টিনেজের সামর্থ নেই ঘুরে বেড়ানোর। 

পৃথিবীর বাইরের দেশ ঘুরে না বেড়ানোর আক্ষেপ শুধু মার্টিনেজেরই নেই, রয়েছে কিউবার অধিকাংশ মানুষেরই। তবে সকলে তাঁর মতো ভেঙে ঘরে বসেই ফেলতে পারেননি সীমান্তের বেড়াজাল। মার্টিনেজের এই গল্প কোথাও গিয়ে যেন সমাপতিত হয়ে যায় বিভূতিভূষণের সঙ্গে। যিনি বাংলায় বসেই বাঙালিকে নিজের চোখে চিনিয়েছিলেন আফ্রিকা। তিনিও তো কোথাও পা দেননি এই ভারতের বাইরে। এই দুই ব্যক্তিত্বই যেন এক সেখানে। আসলে সৃষ্টিকর্তারা বোধ হয় এমনই হন। দূরদর্শী...

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, দক্ষিণ আফ্রিকায় ২১৬ জন ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী পাঠাল কিউবা

More From Author See More