পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিবছর ভারতে সর্পদংশনে মৃত্যু হয় ৪৬ হাজার মানুষের। সাপের সঙ্গে মানুষের এই সংঘাত বৃদ্ধির একমাত্র কারণ নগরায়ন। তবে সাপের অস্তিত্ব মুছে দিলেই এই সমস্যার সমাধান হবে, এমনটা নয় একেবারেই। বরং, উল্টে তাতে বিপত্তি বাড়বে আরও। প্রকৃতি থেকে সাপ অবলুপ্ত হলে, ধ্বসে পড়বে বাস্তুতন্ত্রের চেনা পিরামিড। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু বা ইয়েলো ফিভারের মতো বিভিন্ন রোগের শিকার হবে মানুষ। অর্থাৎ, সাপ ছাড়া বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখা এককথায় অসম্ভব।
মহারাষ্ট্রের প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে এসবই প্রচার করেন ৪৭ বছর বয়সি বনিতা জগদেও বোরাদে। তবে সাধারণের কাছে তিনি পরিচিত ‘সর্পকন্যা’ বা ‘সাপওয়ালি বাঈ’ নামে। বিগত কয়েক দশক ধরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সাপের সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সাপ উদ্ধারেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
মহারাষ্ট্রের বুলদানা জেলার নাইগাঁও অঞ্চলে বেড়ে ওঠা তাঁর। প্রতিবছর গ্রীষ্ণ পড়লেই ছুটি কাটাতে যেতেন দেশমুখ গ্রামে তাঁর বাবার খামারে। সেখানে তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছিল স্থানীয় আদিবাসী কিছু শিশু। খেলা থেকে শুরু করে একসঙ্গে গাছে চড়া কিংবা মাছ ধরা— সারাদিনই চলত দস্যিপনা। সে-সময়ই তিনি দেখেন কী অনায়াসেই সাপ ধরতে পারে তারা। মাছের জালে আটকে যাওয়া সাপকে জাল থেকে ছাড়িয়ে আবার ছেড়ে দেয় প্রকৃতিতে। এই ঘটনাই গভীরভাবে প্রভাব ফেলে বনিতার মনে।
অকুণ্ঠভাবেই বনিতা স্বীকার করেন, তাঁর আজকের জীবনের জন্য তিনি চিরঋণী দেশমুখ গ্রামের সেইসকল আদিবাসী শিশুদের কাছে। বনিতার সাপ উদ্ধারের এই লড়াই শুরু হয়েছিল বছর দশেক বয়সে। বাড়িতে ঢুকে পড়া রেড স্যান্ড বোয়াকে উদ্ধার করে অরণ্যে ছেড়েছিলেন তিনি। বাড়ির লোকজনদের বাধা দিয়েছিলেন সাপটিকে মারতে। ব্যাপারটা স্থানীয়দের মধ্যে জানাজানি হতেই ধীরে ধীরে তাঁর ডাক আসতে থাকে সাপ উদ্ধারের জন্য।
প্রথমে নিরাপত্তার কথা ভেবে বাবা-মা আপত্তি তুললেও, পরে তাঁরাও সায় দেন এই বিষয়ে। সাপ উদ্ধার বিষয়ে নিজেও যথেষ্ট পড়াশোনা এবং গবেষণা করেছেন বনিতা। নিয়েছেন বিশেষ ট্রেনিং। তারপর সাপ উদ্ধারই হয়ে উঠেছে তাঁর পেশা। তবে ‘পেশা’ বললে একটু ভুল হয় বৈকি। কারণ, লোকজনের বাড়ি, খামার কিংবা জলাশয় থেকে সাপ উদ্ধার করলেও কারোর থেকে কোনো পারিশ্রমিক নেন না তিনি। তার কারণও আছে। বনিতার বিশ্বাস, পারিশ্রমিক প্রদানের প্রশ্ন উঠলে, গ্রামের দরিদ্র মানুষরা সাপ মেরে ফেলার সিদ্ধান্তকেই বেছে নেবেন। কাজেই সামাজিক পরিষেবা হিসাবেই এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
সাপ উদ্ধারের বিষয়ে, মহারাষ্ট্রের বনদপ্তরের সঙ্গেও গাঁটছড়া বেঁধেছেন তিনি। সাপ উদ্ধারের নথি ও পরিসংখ্যান সংগ্রহের জন্যই এই উদ্যোগ। উদ্ধার করা সাপ অরণ্যে ছেড়ে দেওয়ার সময়ও তিনি ডাক পাঠান বন বিভাগের আধিকারিকদের। আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেন রেকর্ড বুকে নথি লিপিবদ্ধ করার জন্য। সেই রেকর্ডবুক অনুযায়ী, সবমিলিয়ে এখনও পর্যন্ত ৭৫ হাজারের বেশি সাপ উদ্ধার করেছেন ‘সর্পকন্যা’। একইসঙ্গে তাঁর লড়াই চলছে কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও। সর্পদংশনের একমাত্র ওষুধ অ্যান্টিভেনম— সে-ব্যাপারেও প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সবমিলিয়ে বাস্তুতন্ত্রকে বাঁচাতে তাঁর এই অনন্য প্রচেষ্টাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়…
Powered by Froala Editor