জাদুর হাত ধরে জীবনে ফেরা, কলকাতার 'ম্যাজিক মেলা'র ইতিবৃত্ত

‘জাদু নেহি, কলা হ্যায় জি!’

নিমেষেই মুখ থেকে পাঁচটা গোটা কাঁচের মার্বেল বের করে বললেন সিকান্দার। সিকান্দার এসেছেন জয়পুর থেকে। তাঁর দোস্ত কালাম, গুড্ডু আর ফিরোজ পাণ্ডুয়ার বাসিন্দা। খোলা রাস্তাই তাঁদের মঞ্চ। দর্শক? পথচলতি জনতা। তাঁরা মাদারি। ভারতীয় ম্যাজিকের গুপ্তজ্ঞান যাঁরা বহন করছেন হাজার হাজার বছর ধরে। গত ১৭ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি, তিনদিন ধরে রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকে মোহরকুঞ্জই তাঁদের ঠিকানা। যেখানে বসেছে ‘ষষ্ঠ ম্যাজিক মেলা’ (Magic Fair)। আয়োজনে ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ম্যাজিক অ্যাসোসিয়েটস বা ফিমা (FIMA)। শুধুমাত্র ম্যাজিককে ঘিরে এত বড়ো মাপের উদযাপন হয়তো বাংলায় এই একবারই হয়। সারা ভারতের ম্যাজিশিয়ানরা ভিড় করেন এই মেলায়। দর্শক খুঁজে নেন তাঁদের পছন্দের শিল্পীকে। 

ম্যাজিক মেলার এই তিনদিন সেজে উঠেছিল মোহরকুঞ্জও। ফটক পেরোতেই তাস, চেইনফ্ল্যাগের মায়াবী সজ্জা নজর কাড়ছে দর্শকদের। বসেছে সারি সারি ম্যাজিশিয়ানদের স্টল। সেখানে পাওয়া যাচ্ছে ম্যাজিকের সরঞ্জাম। জাগলিং, ভেন্ট্রিলোকুইজম, হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফি, স্যান্ড অ্যানিমেশন, পাপেট্রি, সাইকো ম্যাজিক, ইল্যুশন কী নেই! জাদুশিল্পিরা স্টল সামলাতে সামলাতেই দেখাচ্ছেন খেলা। উৎসুক জনতার একাংশ হাতে কলমে শিল্পীদের কাছেই তালিম নিচ্ছেন ম্যাজিকের। মাঠের একপ্রান্তে ‘ম্যাজিশিয়ান প্রিন্স শীল স্মৃতি মঞ্চ’। সেখানে বিকেল ৬টা থেকেই শুরু হয়ে যাবে পারফরম্যান্স। গালা শো। এন্ট্রি ফি-র বালাই নেই। দর্শকরা বিনা-টিকিটেই দেখবেন ভারতসেরা জাদুশিল্পীর খেলা। 

প্রথমদিন ভানুমতীকে স্মরণ করে মেলার উদ্বোধন করলেন বিখ্যাত হ্যান্ডশ্যাডোগ্রাফার এবং ফিমার বর্তমান সভাপতি শ্রী অমর সেন এবং প্রবীণ ম্যাজিশিয়ান শ্রী শৈলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। মঞ্চে ছিলেন স্যান্ড অ্যানিমটর স্যান্ড কৌশিক, শান্তনু সেন, দিব্যেন্দু নাথের মতো শিল্পীরাও। এরপর চমক। দিব্যেন্দুর স্লাইট অফ হ্যান্ড-এর খেলায় দর্শক মাত। সুদূর তেলেঙ্গানা থেকে আসা উদয় ভাস্কর ‘ক্লাউনিং’ এবং ম্যাজিকের অপূর্ব মিলন ঘটালেন মঞ্চে। কচিকাঁচারা উদয়ের মজার ভঙ্গিমায় হেসেই খুন। ম্যাজিক নাট্য ‘আলিফ-ল্যায়লা’ সিন্দাবাদের কাহিনিকেও নিয়ে এল মঞ্চে।

ম্যাজিক মেলার শো স্টপার হায়দ্রাবাদের ম্যাজিশিয়ান আলি। ১৩ বার জাতীয় পুরস্কার জয়ী এই জাদুকরের হাতের গুণে শূন্য থেকে আবির্ভূত হল দুশো টাকার নোট। খুদে ম্যাজিক কুইন মিমিও বড়োদের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে মঞ্চ মাতাল। মঞ্চে বালি ছেনে অপূর্ব ছবি আঁকলেন স্যান্ড আর্টিস্ট অঙ্কন বসু। ছিল ম্যাজিশিয়ান এস উত্তমের বিখ্যাত ‘আন্ডা কা ফান্ডা’-র খেলা। ফিমার অন্যতম সদস্য, রজত নরসিংহমকে দেখা গেল বিভিন্ন রূপে। কখনো তিনি কথা-বলা বোর্ড নিয়ে মন জয় করলেন কচিকাঁচাদের। কখনো নেশার ঘোরে টলতে টলতে তাঁর ম্যাজিক হয়ে উঠল নেশা বিরোধিতার স্লোগান।

দ্বিতীয় দিনে মঞ্চ নয়, খোলা মাঠে দেখা গেল আগুনের খেলা। জাগলিং-জুটি নেপাল পাঁজা এবং সুদীপ কোলে অনায়াসেই মুখে পুরলেন আগুনের গোলা। ড্রাগনের মতোই মুখ থেকে বেরোল হল্কা। জ্বলন্ত লাঠি নিয়ে জাগলিং এবং জ্বলন্ত দড়িতে স্কিপিং করতেও দেখা গেল তাঁদের। খানিক বাদেই মঞ্চে ছায়ার মায়ায় দর্শকদের তাক লাগালেন বিখ্যাত হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফার অমর সেন। তাঁর হাতের জাদুতে পর্দার পিছনে নিমেষেই ফুটে উঠল মাদার টেরেজা, রবীন্দ্রনাথের প্রতিচ্ছবি। সৃষ্টি নরসিংহম, মিস মহুয়া এবং স্বনামধন্য জাদুকর শ্যামল কুমারের খেলা দেখে করতালিতে ফেটে পড়ল মঞ্চ। ম্যাজিশিয়ান জুনিয়র নয়নের ‘বিরিঞ্চিবাবা’ ছিল মেলার দ্বিতীয় ম্যাজিক নাটক। সেই নাটকে উঠে এল বুজরুক বাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভাষ্য। 

শেষদিনে একের পর এক চমক দেখা গেল মঞ্চেই। মেলায় উপচে পড়া ভিড়ের সামনেই প্রিন্স শীলকে স্মরণ করে অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি খেলা পরিবেশন করলেন ম্যাজিশিয়ান অভিরূপ। সনৎ নরসিংহম দেখালেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ‘মাছ ধরার খেলা।’ জাদুশিল্পী রাহুল খারবান্দা এবং পলাশ চৌধুরীর আলো-ছায়ার ম্যাজিক এবং মেন্টালিসম দেখে সকলে করতালি দিতেও ভুলে গিয়েছিলেন। জনপ্রিয় ম্যাজিশিয়ান এ-সরকার নতুন আঙ্গিকে ফিরিয়ে আনলেন পরিচিত ‘মানুষ কাটার খেলা’। জাদুকর বরুণ দিলেন ‘পরিবেশ বাঁচানোর বার্তা’। পুতুল পাখি সাওয়ান্তের কথার ম্যাজিকে মেলাজুড়ে হাসির হররা। রজত নরসিংহমের তৃতীয় ম্যাজিক নাটক দিয়ে শেষ হল গালা শো। শো-এর মাঝেই ‘ফিমা’র প্রথম লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার পেলেন কিংবদন্তি জাদুশিল্পী স্যাম দালাল। সংবর্ধিত হলেন মাদারিরাও…

হাওড়ার অরূপ চক্রবর্তী ঘুরতে ঘুরতেই ঢুকে পড়েছিলেন মোহরকুঞ্জে । স্টলে বিভিন্ন ম্যাজিকের সরঞ্জাম নেড়েছেড়ে দেখতে দেখতে ফিরে গিয়েছিলেন ছোটবেলায়। গালা শো দেখতে দেখতে শিশুসুলভ বিস্ময়ে করতালিতে ফেটে পড়েছেন। আগামী বছরের জন্য মুখিয়ে রয়েছেন তিনি। এই বিস্ময় নিয়েই কথা হচ্ছিল, তরুণ ম্যাজিশিয়ান তনিষ্কার সঙ্গে। কলেজপড়ুয়া তনিষ্কা বলছিলেন, পড়াশোনার পাশাপাশি তাঁর ম্যাজিক-অনুশীলন চালিয়ে যাওয়ার কথা। খানিক সন্দিগ্ধভাবেই প্রশ্ন রেখেছিলাম, বর্তমান প্রজন্মের ম্যাজিকে আগ্রহ নিয়ে। আমাকে আশ্বস্ত করলেন তিনি। ইন্টারনেট যুগেও এখনও কচিকাঁচাদের মন থেকে বিস্ময় কমে যায়নি। 

এই ষষ্ঠ ম্যাজিকমেলার গুরুত্ব ভারতীয় ম্যাজিশিয়ানদের জন্য অপরিসীম। ২০০৯ থেকে শুরু হওয়া এই মেলা, বন্ধ ছিল দু'বছর। অতিমারী কেড়ে নিয়েছিল জাদুশিল্পীদের উপার্জন। ফিমার অন্যতম কর্মী ভোলানাথ দাসের কাছে শুনছিলাম সেই অন্ধকার সময়ের গল্প। যখন ম্যাজিশিয়ানরা দর্শক হারিয়ে বেছে নিচ্ছিলেন উবার চালানো, কুরিয়ার সার্ভিসের কাজ। ধীরে ধীরে কাটছে হতাশার মেঘ। ম্যাজিশিয়ানরা আবার ফিরে পাচ্ছেন তাঁদের চেনা মঞ্চ। বাড়ছে উপার্জনও। তাই ম্যাজিক মেলার শেষলগ্নে খানিক আবেগাআপ্লুতই হয়ে পড়লেন জাদুশিল্পীরা।

ছবি : হিয়া ভুঁইয়া

Powered by Froala Editor