বোলপুরে 'পৃথ্বীরাজ পরাজয়' লিখলেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ, ডাইরির সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেই কাব্যও

সূর্যস্নান পর্ব ৯।।
উপনয়নের পর রবি ভয়ানক ভাবনায় পড়ল। ন্যাড়া মাথা নিয়ে ইস্কুলে যাওয়া - সে কেমন করে হয়? ফিরিঙ্গি সহপাঠীদের দেব-দ্বিজে ভক্তি নেই, তারা নতুন ব্রাহ্মণের মুণ্ডিত মস্তক দেখে যে কীরকম হাসাহাসি করবে কে জানে! এমন দুশ্চিন্তার সময়ে তার ডাক পড়ল তেতলার ঘরে, পিতৃদেবের সকাশে। দেবেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, রবি তাঁর সঙ্গে হিমালয়ে যেতে যায় কিনা। প্রৌঢ় বয়সে কবি লিখেছেন, "'চাই' এই কথাটা যদি চীৎকার করিয়া আকাশ ফাটাইয়া বলিতে পারিতাম, তবে মনের ভাবের উপযুক্ত উত্তর হইত। কোথায় বেঙ্গল একাডেমি আর কোথায় হিমালয়।" 

রবির জন্য বানানো হল নতুন পোশাক, সঙ্গে জরির কাজ করা গোল মখমলের টুপি। যাত্রার আগে, চিরাচরিত রীতিতে বাড়ির সকলকে নিয়ে দালানে উপাসনা করলেন মহর্ষি। গুরুজনদের প্রণাম করে বাবার সঙ্গে গাড়িতে চড়ল রবি। রেলপথে সন্ধ্যার সময় বোলপুরে পৌঁছনো গেল। এরপর পালকির ব্যবস্থা। পালকিতে চড়ে চোখ বুজল কিশোর। একেবারে পরের দিন প্রভাতী আলোয় বোলপুরের সমস্ত বিস্ময় তার চোখের সামনে পরতে পরতে খুলে যাবে, এই তার ইচ্ছা। সন্ধ্যার অস্পষ্টতার মধ্যে তার আভাস পেয়ে গেলে, আগামীকালের অখণ্ড আনন্দের রসভঙ্গ হবে যে!

পরবর্তীতে এই যাত্রার স্মৃতিচারণ করে কবি বলেছেন, "শান্তিনিকেতনে এসেই আমার জীবনে প্রথম সম্পূর্ণ ছাড়া পেয়েছি বিশ্বপ্রকৃতির মধ্যে। উপনয়নের পরেই আমি এখানে এসেছি। উপনয়ন-অনুষ্ঠানে ভূভুর্বঃস্বলোর্কের মধ্যে চেতনাকে পরিব্যাপ্ত করবার যে দীক্ষা পেয়েছিলেম পিতৃদেবের কাছ থেকে, এখানে বিশ্বদেবতার কাছ থেকে পেয়েছিলেম সেই দীক্ষাই। আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্রথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত।" 

এইখানে শান্তিনিকেতনের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটা কথা বলে নেওয়া যাক। একবার রায়পুর যাওয়ার সময় পালকি থেকে দেবেন্দ্রনাথের চোখে পড়ল উত্তরদিকে সীমাশূন্য প্রান্তর, তাতে কয়েকটি বন্য খেজুরগাছের মধ্যে ডালপালা মেলে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মাত্র সপ্তপর্ণী। কাছেই একটি দিঘি, তার নাম ভুবনডাঙার বাঁধ, অথবা ভুবন-সাগর। মুগ্ধ হলেন মহর্ষি। সেই ছাতিমতলার কাছে বিশ বিঘে জমি তিনি রায়পুরের জমিদারের থেকে খরিদ করে নিলেন (১২৬৯ বঙ্গাব্দের ১৮ ফাল্গুন)। এখানে নিভৃতে ব্রহ্মসাধনার জন্য তিনি নির্মাণ করলেন বাসগৃহ, উপাসনা মন্দির ও গ্রন্থাগার। সেই উদ্দেশ্যে এই ভবনের ব্যবহার খুব বেশি হত না, আত্মীয়রা সাধারণত এখানে আসতেন ছুটি কাটাতে, কিংবা বায়ু পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে। এবার, কিশোর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে বোলপুরে এসে উঠলেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ। এইখানেই ঘটল পিতার সঙ্গে পুত্রের প্রথম ঘনিষ্ঠ পরিচয়, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে কবির প্রথম প্রণয়। 

আরও পড়ুন
কিশোর রবির জন্য নতুন উপনয়ন-বিধি দেবেন্দ্রনাথের, আপত্তি উঠল ব্রাহ্মদের মধ্যে থেকেই

উত্তরকালে স্মৃতির ভাঁড়ার থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, "সেই বালকবয়সে এখানকার প্রকৃতির কাছ থেকে যে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেম-- এখানকার অনবরুদ্ধ আকাশ ও মাঠ, দূর হতে প্রতিভাত নীলাভ শাল ও তাল শ্রেণীর সমুচ্চ শাখাপুঞ্জে শ্যামলা শান্তি, স্মৃতির সম্পদরূপে চিরকাল আমার স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। তার পরে এই আকাশে এই আলোকে দেখেছি সকালে বিকালে পিতৃদেবের পূজার নিঃশব্দ নিবেদন, তার গভীর গাম্ভীর্য। তখন এখানে আর কিছুই ছিল না, না ছিল গাছপালা, না ছিল মানুষের এবং কাজের এত ভিড়, কেবল দূরব্যাপী নিস্তব্ধতার মধ্যে ছিল একটি নির্মল মহিমা।" 

আরও পড়ুন
যদুভট্টের থেকে পালিয়ে বেড়াতেন রবীন্দ্রনাথ, স্বীকার করেছেন নিজের গানের সীমাবদ্ধতাও

ইতোমধ্যে কিশোর কবির হাতে উঠে এসেছিল একখানা বাঁধানো ডাইরি। বোলপুরে একটি ছোট্ট নারকেল গাছের তলায় পা ছড়িয়ে বসে সেই ডায়রিতে আপন খেয়ালে কাব্য রচনা করে যেত রবি। তৃণহীন কাঁকরের শয্যায় রোদের উত্তাপের মধ্যে বসে বসে 'পৃথ্বীরাজ পরাজয়' নামে একখানা দুর্ধর্ষ বীররসের কাব্য লিখে ফেলেছিল সে। দুর্ভাগ্য এই যে, সেই ডাইরির সঙ্গে সঙ্গে কাব্যখানাও পরে কোথায় যে অন্তর্হিত হয়েছে, তার ঠিকানা পাওয়া যায়নি। 

আরও পড়ুন
ভেসে এল কান্নার শব্দ, মেয়েকে শেষবার না-দেখেই গাড়ি ঘোরালেন রবীন্দ্রনাথ

পুত্রকে কাজেকর্মে সড়োগড়ো করে তোলার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। কিছু কিছু জমাখরচের হিসেব রাখা, ঘড়িতে দম দেওয়া - এরকম টুকিটাকি কাজের দায়িত্ব পড়ল রবির ওপর। রবি ভুল করলেও দমে যেতেন না পিতা, বরং সকৌতুক প্রশ্রয়ে উৎসাহ দিতেন। ভগবদগীতায় মহর্ষির প্রিয় শ্লোকগুলি চিহ্নিত করা ছিল, সেগুলি বাংলা অনুবাদ সমেত কপি করার ভার দেওয়া হল রবিকে। এমন সব গুরুতর কাজের দায়িত্ব পেয়ে গৌরবে পুলকিত হল কিশোর। 

আরও পড়ুন
তর্কের জবাব দিতেন না ‘বৌঠাকরুন’, কাদম্বরীর কাছে রবীন্দ্রনাথের হার ছিল অবশ্যম্ভাবী

সন্ধ্যাবেলা খোলা আকাশের নীচে বসে উৎসুক রবিকে সৌরজগতের গ্রহমণ্ডলের বিবরণ বলতেন দেবেন্দ্রনাথ। অনন্ত অন্ধকার শূন্যতার মধ্যে ছড়িয়ে থাকত বিন্দু বিন্দু আলোককণা, তার নীচে বসে বিশ্বজগতের রহস্য আলোচনা করতেন দুটি মানুষ। 

আরও পড়ুন
‘কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং’ – স্বল্প স্কুলজীবনে এমনই আবৃত্তি শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

এইখানে, চাকরদের শাসনের হাত এড়িয়ে প্রথম উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে যথেচ্ছ বিহারের সুযোগ পেলেন রবীন্দ্রনাথ। বোলপুরের মাঠের মধ্যে এখানে-ওখানে বর্ষার জলধারায় বালিমাটি ক্ষয় হয়ে যেত। লাল কাঁকর ও নানারকম পাথরে খচিত ছোটো ছোটো শৈলমালা গুহাগহ্বর নদী-উপনদী রচনা করে, প্রকৃতি যেন এখানে "বালখিল্যদের দেশের ভূবৃত্তান্ত" প্রকাশ করেছে। এসবের মধ্যে বেড়াতে গিয়ে আঁচল ভরে পাথর কুড়িয়ে নিয়ে আসে রবি। পিতার কাছে উৎসাহ পেয়ে, সে সেইসব পাথর দিয়ে বাড়ির সামনে বানানো একটি কৃত্রিম পাহাড়কে সাজিয়ে তোলে। এই পাহাড়ে ভোরবেলা চৌকি নিয়ে উপাসনায় বসতেন দেবেন্দ্রনাথ, তাঁর সম্মুখে সূর্যোদয় ঘটত পুবদিকের প্রান্তরে। রবির নিতান্ত ছোটো ছোটো খেয়ালকেও দেবেন্দ্রনাথ নিরস্ত করতেন না। একবার রবি দেখে এল খোয়াইয়ের মধ্যে ছোট্ট একটি স্বচ্ছ জলের ধারা। সোৎসাহে বাবাকে বলল, সেখান থেকে স্নান ও পানের জল আনালে কেমন হয়? "তাইতো, সে তো বেশ হইবে" - বললেন দেবেন্দ্রনাথ। আবিষ্কারকর্তাকে পুরস্কৃত করার জন্য সেখান থেকেই জল আনার ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। 

আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির আনাচে-কানাচে চালু ছিল ভূত-প্রেতের গল্পগুজব

দূরদর্শী মহর্ষির অন্তর্দৃষ্টি অমোঘ। উত্তরকালে এই রবিই পিতার কাছে শান্তিনিকেতন আশ্রমের ভার চেয়ে নেবেন, মহর্ষির আরব্ধ কার্য সার্থক হবে। দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্মের আদর্শ রবীন্দ্রনাথের মনোলোকে উজ্জীবিত হয়ে নবকলেবরে বিশ্বধর্ম-রূপে বিশ্বভারতীর মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠবে। আশ্রমিকেরা সমস্বরে গাইবেন, "বিশ্ববিদ্যাতীর্থপ্রাঙ্গন কর’ মহোজ্জ্বল আজ হে। / বরপুত্রসংঘ বিরাজ’ হে ।"

আরও পড়ুন
বাংলার ছড়া তাঁর কাছে 'জাতীয় সম্পত্তি', চিরন্তনতায় মুগ্ধ হয়েছেন বারবার

Powered by Froala Editor