প্রায় ২৭০০ বছর ধরে তাঁরা ভারতের বুকে আছেন। এতদিন থাকলে যে কোনো জনজাতিই অন্য একটা দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যেতে পারে। বিনেই মেনাশে উপজাতির মানুষরাও মিশে গিয়েছিলেন। কিন্তু আবার তাঁর ফিরে যাচ্ছেন তাঁদের ‘হোমল্যান্ড’ ইজরায়েলে। কারণ তাঁদের বিশ্বাস তাঁরা মধ্যপ্রাচ্য থেকে হারিয়ে যাওয়া ইহুদি উপজাতি (Lost Jewish Tribe)। তাই এতদিন মেঘালয় এবং মায়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চলে কাটিয়েও জেরুজালেমের আকর্ষণ তাঁরা ভুলতে পারেননি।
জেরুজালেমের মাটিতে ইহুদিদের প্রথম মন্দির তৈরির সময়েই ভেঙে যায় ইহুদিদের রাজত্ব। জেরুজালেম শহরের দক্ষিণে তৈরি হয় কিংডম অফ জুডাহ, আর উত্তরাঞ্চলে ১০টি ইহুদি উপজাতির রাজত্ব। এভাবেই বেশ কয়েকশো বছর চলার পর হঠাৎ নেমে আসে আসিরীয় আক্রমণ। সময়টা আনুমানিক ৭৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৭২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। আসিরীয় আক্রমণের পর ইজরায়েলের ১০টি ইহুদি উপজাতির হদিশ আর কেউ পাননি। অনেকের মতে, প্রত্যেককেই বন্দি করে নিয়ে গিয়েছিল আসিরীয়রা। তারপর তাদের ক্রীতদাস হিসাবে রেখে দেয়। আবার অনেকের মতে, কয়েকজন আসিরীয়দের হাতে বন্দি হলেও অধিকাংশই পালিয়ে গিয়েছিল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। আর তখনই বিনেই মেনাশে নামের উপজাতিটি চলে আসে মেঘালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে।
মেঘালয়ের অন্যান্য উপজাতিরা প্রায় সকলেই প্রকৃতিপূজারী। কালক্রমে ওল্ড টেস্টামেন্টের ধারকরাও মিশে গিয়েছিলেন সেই জীবনের সঙ্গে। তবে সেইসঙ্গে ওল্ড টেস্টামেন্টের কাহিনিও ছড়িয়ে পড়েছিল স্থানীয় মানুষদের মুখে মুখে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতের খ্রিস্টান মিশনারিরা এইসব গল্পের সন্ধান পেয়ে অবাক হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, মানুষের মধ্যে প্রচলিত সেইসব কাহিনি মিশনারিদের যথেষ্ট সাহায্যই করেছিল। বিরাট অংশের মানুষ আবার বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তাঁরা একসময় জেরুজালেমের মাটিতে বিচরণ করতেন। যদিও খ্রিস্টান মিশনারিরা তাঁদের খ্রিস্টধর্মেই নিয়ে এসেছিলেন।
কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা বুঝতে পারলেন, তাঁদের প্রচলিত কাহিনিগুলি কেবল ওল্ড টেস্টামেন্টের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। নিউ টেস্টামেন্টের সঙ্গে তার বিশেষ মিল নেই। আর তাই খ্রিস্টধর্ম থেকে বেরিয়ে এসে তাঁরা ইহুদি ধর্মপালন শুরু করলেন। সেটা গত শতাব্দীর ৭০-এর দশক। দেশ তখন স্বাধীন হয়েছে। সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী মেঘালয়ের প্রায় ৬ হাজার মানুষ ইহুদি ধর্ম পালন করেন। কিন্তু তারপরেও সরকারি ব্যবস্থায় ইহুদি ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি মেঘালয়ে। তাই কর্মক্ষেত্রে কোনো ইহুদি উৎসবের জন্য ছুটিও পান না তাঁরা। এই বিষয় নিয়ে আদালতে মামলাও গড়িয়েছিল। ২০০৩ সালে ইজরায়েলের একটি পরীক্ষাগারে ৩০০ মানুষের ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু তাতে তাঁদের শরীরে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো জনজাতিরই জিন পাওয়া যায় না। ২০০৫ সালে কলকাতায় আরেকটি পরীক্ষা হয়। তাতেও দেখা যায় পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলীয় উপজাতির সঙ্গেই সাদৃশ্য রয়েছে তাঁদের। ফলে সরকারিভাবে তাঁদের বিনেই মেনাশে বলে স্বীকার করা হয়নি আর।
আরও পড়ুন
৪০ হাজার ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়ে হলোকাস্ট-হিরো জাপানের সুগিহারা
তবে এর মধ্যেই ৯০-এর দশক থেকে বেশ কিছু ইহুদি ধর্মপ্রচারক ইজরায়েল থেকে ভারতে আসতে থাকেন। এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় ইজরায়েলের ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন বিরোধের রাজনৈতিক সমীকরণও। শুরু হয়ে যায় তাঁদের ইজরায়েলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজও। গত এক দশকে অন্তত ১ হাজার মানুষ ফিরে গিয়েছেন তাঁদের মাতৃভূমিতে। তবে কেবলমাত্র রাজনৈতিক সমীকরণের হিসাবে পুরোটাকে না দেখে মানুষের বিশ্বাসকে স্বীকৃতি দিলেই হয়তো ভারতের মাটিকেও নিজেদের ‘হোমল্যান্ড’ বলে মনে করতে পারতেন ইহুদিরা। তাই ইতিহাসের নিয়মে শক, হূন, পাঠান, মোঘল ভারতের সংস্কৃতিতে মিশে গেলেও বিনেই মেনাশেরা পারলেন না। অথবা পেরেও আবার আলাদা হয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, উদ্বাস্তু জীবন পেরিয়ে ৯৭ বছরে ঘর পেলেন ইহুদি মহিলা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ইহুদি যুবকটির হাসি সুন্দর; খুলিতে পাথর ভরে পেপারওয়েট বানালেন নাৎসি চিকিৎসক!