রাতে যখন ঘুমতে গিয়েছিলেন তখনও মাথার ধারে ছিল ল্যাম্পশেড। পাশে রাখা ছিল বই-খাতা। ঘুম থেকে উঠে দেখলেন বদলে গেছে সবকিছু। অজানা প্রযুক্তিরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে। এমনকি ক্যালেন্ডারের তারিখও এগিয়ে গেছে প্রায় কয়েক বছর। ক্যাপ্টেন আমেরিকা সিনেমাতেও দেখানো হয়েছিল অনুরূপ একটি দৃশ্য। কিন্তু এমনটাই যদি ঘটে বাস্তবে?
হ্যাঁ, রূপকথা নয়। আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল বাস্তব পৃথিবীর বুকেই। এলেন স্যাডলার (Ellen Sadler) নামের এক ব্রিটিশ কিশোরীর ঘুম ভাঙতে সময় লেগেছিল প্রায় ১১ বছর। বলাই বাহুল্য, ১১ বছরে প্রযুক্তিগতভাবে বদলে গিয়েছিল তার চারপাশের পরিবেশ। আজও বিশ্বের দীর্ঘতম ঘুমের (Longest Sleep) দৃষ্টান্ত হিসাবে বিবেচনা করা হয় এলেনের এই ঘটনাকেই। কিন্তু দীর্ঘ ১১ বছর ঘুম না ভাঙার কারণ কী?
শুরু থেকেই তবে বলা যাক। সেটা ১৮৭১ সাল। তখন মাত্র ১১ বছর বয়স তাঁর। অন্যদিনের মতো তিন ভাইবোনের সঙ্গে ঘুমতে গিয়েছিলেন এলেন। তবে সকালের আলো ফুটে যাওয়ার পরেও ঘুম ভাঙল না তাঁর। এলেনকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা-চরিত্রও কম হয়নি। তাতেও কোনো লাভ না হলে, ধরে নেওয়া হয় আকস্মিক কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি। ডাকা হয় চিকিৎসককেও। তবে হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক দেখে তিনিও সমাধান করতে পারেননি এই রহস্যের। প্রাথমিকভাবে তাঁর অভিমত ছিল, দেহ জীবিত থাকলেও, মারা গিয়েছে এলেনের মস্তিষ্ক।
কিন্তু তাতেও কি হাল ছেড়ে দেওয়া যায়? জ্ঞান থাকুক বা না থাকুক, সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে সর্বস্ব দিয়েই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন এলেনের মা। ঘুমন্ত অবস্থাতেই তাঁর মুখে চামচে করে খাবার তুলে দিতেন তিনি। খাবার বলতে দুধ, ওয়াইন, ওটসের সরবত— এসবই। সেইসঙ্গে দৈনন্দিন চিকিৎসকদের আনাগোনাও লেগে থাকত তাঁর বাড়িতে। অবশ্য চিকিৎসার খরচের জন্য খুব একটা ভাবতে হত না এলেনের দরিদ্র পরিবারকে। কারণ, ততদিনে রীতিমতো সেলেব্রিটি হয়ে উঠেছেন তিনি। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন টাকা খরচ করেই দেখতে আসত বাকিংহামশায়ারের এই কিশোরীকে। অচিরেই তাঁর পরিচয় হয়ে ওঠে ‘স্লিপিং গার্ল’। জনশ্রুতি ছড়িয়ে পড়ে, এলেন আদতে রাজকুমারী। রূপকথার রাজকুমার এসে তাঁকে চুম্বন করলেই ঘুম ভাঙবে তাঁর। কেউ আবার স্মারক হিসাবে এলেনের চুল সংগ্রহ করতেন টাকার বিনিময়ে।
আরও পড়ুন
সরকারের উদ্যোগেই ৩ লক্ষ শিশু চুরি স্পেনে, যুক্ত ছিলেন চিকিৎসকরাও!
এভাবেই কেটেছিল প্রায় ১১টা বছর। ২১ বছর বয়সে ঘুম ভাঙে এলেনের। ততদিনে চিকিৎসাবিজ্ঞান খানিকটা এগিয়েছে প্রযুক্তিগত দিক থেকে। অনেকটা বদলে গেছে চারদিকের পরিবেশও। ফলে, নিজেকে এই নতুন পরিস্থিতিতে মানিয়ে নেওয়া তাঁর কাছে ছিল দুঃস্বপ্নের মতোই। এলেন শৈশবেই হারিয়েছিলেন বাবাকে। ঘুম ভাঙার পর জানতে পারেন, মাস ছয়েক আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন তাঁর মা-ও। এলেনের দৈহিক বয়স তখন ২১ বছর হলেও, তাঁর মানসিকতা আটকে ছিল ১১-তেই। ফলে, ভয়াবহ ট্রমার শিকার হন ব্রিটিশ তরুণী।
আরও পড়ুন
প্রকাশিত মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ডার্ক ম্যাটারের মানচিত্র, ভুল ছিলেন আইনস্টাইন?
তৎকালীন সময়ে এক চিকিৎসক এলেনের ঘটনার বিশ্লেষণ করে এই বিশেষ রোগটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘স্লিপিং সিকনেস’ নামে। আজকাল সকলেই কম-বেশি এই শব্দবন্ধের সঙ্গে পরিচিত। আর এই ‘স্লিপিং সিকনেস’-এর কারণ? সেটার কোনো ব্যাখ্যা মেলেনি সে-সময়। পরবর্তীতে গবেষকরা সমাধান করেন এই রহস্যের। মূলত, ওরেক্সিন নামের একটি বিশেষ হাইপোক্রেটিন উৎসেচক ক্ষরণ হয় মানুষের মস্তিষ্ক থেকে। যা শারীরবৃত্তিয় ঘড়িকে পরিচালনা করে। মানুষের ঘুম ভাঙার জন্যও দায়ী এই জৈব-রাসায়নিক পদার্থটিই। এই বিশেষ উৎসেচকের ক্ষরণই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এলেনের শরীরে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় নারকোলেপসি।
আরও পড়ুন
যোগ্যতা সত্ত্বেও সুযোগ পাননি টেস্ট দলে, বাঙালি-বঞ্চনার শিকার ছিলেন গোপাল বসু?
অবশ্য, বাকি জীবদ্দশায় এলেনকে দ্বিতীয়বার এহেন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। ১৯১০ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে আকস্মিকভাবেই মারা গিয়েছিলেন তিনি। তবে এলেনকে নিয়ে নানান লোককথা আজও বিরাজমান অক্সফোর্ডের বাকিংহামশায়ারে। দীর্ঘতম ঘুমের সৌজন্যে ইতিহাসের পাতাতেও জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম…
Powered by Froala Editor