১৮৪০ সাল। গবেষণার কাজেই কনস্ট্যান্টিনোপোলের গ্রিক অর্থোডক্স লাইব্রেরিতে হাজির হয়েছিলেন বাইবেলবিদ কনস্ট্যান্টিন ভন টিসেনডর্ফ। মধ্যযুগে পূর্ব ইউরোপে প্রচলিত প্রাচীন খ্রিস্টান গান এবং প্রার্থনা সংগ্রহ করাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য। আর এই কাজ করতে গিয়েই তিনি হাতে পেলেন চামড়ার পাতায় লেখা আশ্চর্য এক পুঁথি। আশ্চর্য বলা এই কারণেই, কেন-না শুধু যে মন্ত্রই লেখা রয়েছে তাতে, এমনটা নয়। সেই বই-এর প্রতিটি পাতায় প্রার্থনাসঙ্গীতের নিচে আড়াআড়ি ভাবে লেখা রয়েছে গাণিতিক কোনো সূত্র। অবশ্য সেই লেখা খুবই ঝাপসা। শুধু বয়সের জন্যই নয়, ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাচীন এই লেখাগুলিকে পাতা থেকে তুলে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, স্পষ্টই বুঝতে পারলেন টিসেনডর্ফ। কিন্তু কার এই লেখা? কেনই বা তুলে ফেলা হয়েছিল সেগুলি?
না, সে-ব্যাপারে কোনো উত্তর ছিল না লাইব্রেরিয়ান এবং কিউরেটরের কাছে। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্য গ্রন্থটি নিজের কাছে রাখার অনুরোধ জানালেও, প্রত্যাখ্যাত হন টিসেনডর্ফ। তবে উপায়? বাধ্য হয়েই পাণ্ডুলিপির শেষ দুটি পাতা চুরি করলেন তিনি। ছিঁড়ে নিয়ে চলে এলেন নিজের সঙ্গে। সংরক্ষণ করলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। না, জীবদ্দশায় এই ধাঁধাঁর সমাধান করতে পারেননি তিনি। তারপর টেমসের বুক দিয়ে বয়ে গেছে বহু জল। এর প্রায় ৭০ বছর পর, প্রকাশ্যে আসে ‘মুছে যাওয়া’ মূল লেখাটির নেপথ্যে রয়েছেন খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের কিংবদন্তি পদার্থবিদ, গণিতজ্ঞ, বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক আর্কিমিডিস (Archimedes)।
‘আর্কিমিডিয়ান প্যালিম্পসেস্ট’ (Archimedes Palimpsest)। কনস্ট্যান্টিনোপোলের লাইব্রেরিতে পাওয়া সেই প্রাচীন গ্রন্থটি পরিচিত এই নামেই। প্যালিম্পসেস্ট বলতে, একটি বিশেষ ধরনের লেখনশৈলী। সাধারণত, একই পাতার ওপর একাধিক স্ক্রিপ্ট উপরিপাতিত করে লেখা হলে, তাকে প্যালিম্পসেস্ট বলা হয়। কখনও আবার গোপন কোনো তথ্য লিপিবদ্ধ করতেও ব্যবহৃত হত এই পদ্ধতি। পৃথক পৃথক কাগজে লেখা হত বিচ্ছিন্ন কিছু অক্ষর বা শব্দরাশি, সেগুলোকে উপরিপাতিত করলেই ফুটে উঠত মূল লেখা। মধ্যযুগে, বিশেষত দশম থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে প্যালিম্পসেস্টের ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ইউরোপে। দুর্মূল্য প্রাচীন কাগজ কিংবা চামড়ার গ্রন্থের মূল লেখাগুলি মুছে ফেলে, তাকে নতুন করে ব্যবহৃত করা হত খাতা হিসাবে।
এমনই অবিচার হয়েছিল আর্কিমিডিসের বইটির ক্ষেত্রেও। ছুরি দিয়ে আর্কিমিডিসের মূল গ্রন্থের লেখাগুলি তুলে ফেলেছিলেন ত্রয়োদশ শতকের এক ধর্মযাজক। লিপিবদ্ধ করেছিলেন খ্রিস্টান প্রার্থনাসঙ্গীত। মজার বিষয় হল, আর্কিমিডিসের লেখা যে ৭টি গ্রন্থের কথা আমরা জানি, তার মধ্যে দুটি গ্রন্থই লিপিবদ্ধ হয়েছিল এই প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে। জ্যামিতি, পদার্থবিদ্যা ও আধুনিক গণিতে ‘মেথড অফ মেক্যানিক্যাল থিওরেম’ ও ‘স্টোমাকিয়ন’-খ্যাত এই দুটি গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে উদ্ধার সম্ভব হল ‘মুছে দেওয়া’ আর্কিমিডিসের এই গ্রন্থ দুটি?
সেই গল্পেই ফেরা যাক বরং। ১৯০৬ সাল। কেমব্রিজের লাইব্রেরিতে গবেষণা করতে গিয়েই টিসেনডর্ফের চুরি করে আনা পাতা দুটির হদিশ পান ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জোহান হাইবার্গ। ঝাপসা হয়ে যাওয়া হরফগুলিকে পরীক্ষা করে তিনিই প্রথম চিহ্নিত করেন, হাতের লেখাটি আসলে আর্কিমিডিসের। লাইব্রেরির ক্যাটালগ ঘাঁটাঘাঁটি করতেই জানতে পারেন, এই পাতা দুটি সংগ্রহ করে আনা হয়েছে সুদূর কনস্ট্যান্টিনোপোলের লাইব্রেরি থেকে। মূল গ্রন্থটি উদ্ধার করতে গ্রিক অর্থোডক্স লাইব্রেরিতে ছোটেন হাইবার্গ। গ্রন্থটি গবেষণার জন্য সংগ্রহ করতে চাইলে টিসেনডর্গের মতোই প্রত্যাখ্যাত হন তিনি। তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ অবধি অনুমতি পান গোটা গ্রন্থটির ছবি তোলার।
অবশ্য পুরো বইটির ছবি তুললেও, খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি হাইবার্গ। মাত্র কয়েকটা পাতার বিছিন্ন কিছু বর্ণমালা, গাণিতিক সমীকরণ, নকশা এবং বাক্যই ডিকোড করতে পেরেছিলেন তিনি। তবে তাঁর দৌলতেই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে এসেছিল আর্কিমিডিসের এই অজানা গ্রন্থটির কথা। এর পর ঘটে যায় আরও এক বিপত্তি। বছর কয়েকের মধ্যেই বিশ্বযুদ্ধের ডঙ্কা বেজে ওঠে গোটা ইউরোপজুড়ে। সে-সময়ই কনস্ট্যান্টিনোপোলের গ্রিক অর্থোডক্স লাইব্রেরি থেকে সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায় আর্কিমিডিসের পাণ্ডুলিপিটি।
এর প্রায় ৮ দশক পর, গ্রন্থটি প্রকাশ্যে আসে ১৯৯৮ সালে। প্যারিসের এক প্রত্ন-সংগ্রাহকের কাছে সন্ধান মেলে এই বইটির। জানা যায়, চোরাবাজারের এক বিক্রেতার কাছ থেকেই তিনি নিলামে কিনেছিলেন এই গ্রন্থ। ২ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে, গ্রন্থটি তাঁর থেকে সংগ্রহ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল্টার্স আর্ট মিউজিয়াম। সেখানেই পরবর্তী এক দশক ধরে চলেছে গবেষণা। খুলেছে একের পর এক জটিল ধাঁধাঁর পরত।
এক্সরে, ইনফ্রারেড রশ্মি এবং থার্মাল ইমেজিং-এর মাধ্যমে স্ক্যান করে আর্কিমিডিসের মূল গ্রন্থ দুটি উদ্ধার করা হয় চামড়ার পাতা থেকে। তবে সহজ ছিল না কাজটা। কারণ, এক্স-রে ছবিতে ধরা পড়ে, বেশ কিছু স্তবক ও বাক্যের শব্দের বয়স মাত্র ৩০-৪০ বছর। এবং আক্ষরিক অর্থে কোনো মানেই দাঁড়ায় না সেই অংশগুলোর। স্পষ্টই বোঝা যায়, মূল পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ মুছে গিয়েছিল সম্পূর্ণভাবে। আর সেই অভাব পূরণ করতে, অর্থাৎ গ্রন্থটিকে আসল দেখানোর জন্যই চোরা-পাচারকারীরা কৃত্রিমভাবে এলোমেলো শব্দবন্ধ লিখে দিয়েছে গ্রন্থটিতে।
তবে হার মানেননি গবেষকরা। গণিতজ্ঞ ও ইতিহাসবিদদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল এক বিশেষ কমিটি। অনুমান, যুক্তি ও গবেষণার ভিত্তিতেই তাঁরা শূন্যস্থান পূরণ করেন মূল পাণ্ডুলিপির মুছে যাওয়া অংশগুলির। তৈরি করেন মূল পাণ্ডুলিপিটির ডিজিটাল সংস্করণ। এমনকি ২০০৮ সালে তৈরি করা হয় একটি বিশেষ ওয়েবসাইট। এক ক্লিকেই সেখানে গিয়ে গোটা গ্রন্থটি পড়ে দেখতে পারেন সাধারণ মানুষও। তবে অস্বীকার করার জায়গা নেই, এই পাণ্ডুলিপি মুছে ফেলার চেষ্টা না হলে, হয়তো আরও আগেই বিকশিত হত আধুনিক গণিত…
Powered by Froala Editor