মাটির ওপরে যানবাহনের হর্ন, কোলাহল, দূষণ। অথচ সিঁড়ি বেয়ে পাতালে প্রবেশ করলেই এক অন্য জগৎ। মাটির তলা দিয়ে ছুটে চলেছে নির্ঝঞ্ঝাট টিউব রেল (Tube Rail)। লন্ডনের ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে এমনই বৈপরীত্য। তবে শুধু পরিবহন পরিষেবাই নয়, এই সুড়ঙ্গই একটা সময় ত্রাতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল লন্ডনের (London)। প্রাণ বাঁচিয়েছিল হাজার হাজার মানুষের।
লন্ডনের পিকাডেলি টিউব রেল স্টেশন থেকে আরও খানিকটা এগিয়ে গেলেই দেখা মিলবে আরও একটি স্টেশনের। ডাউন স্ট্রিট। তবে আর পাঁচটা অন্য টিউব রেল স্টেশনের মতো জীবন্ত নয় সেটা। তালা ঝুলছে গেটে। কোনোক্রমে ভেতরে ঢুকে পড়লে মনে হবে ঠিক যেন এসে হাজির হয়েছেন পাতালঘরে। চতুর্দিক অযত্নের ছাপ। কিছুই নেই সেখানে। আবার অনেক কিছুই আছে। সময়টা চল্লিশের দশকের শুরু দিক। বিশ্বযুদ্ধের সমস্ত গতিপ্রকৃতিই নিয়ন্ত্রিত হত পরিত্যক্ত এই রেলস্টেশন থেকে। প্রায় সাড়ে সাত দশক পর এবার এই পাতালঘরকেই আস্ত মিউজিয়ামের রূপ দিল ব্রিটিশ সরকার। আজ থেকেই ডাউন স্ট্রিট টিউব স্টেশন খুলে যাচ্ছে দর্শকদের হেরিটেজ ওয়াকের জন্য।
বিশ শতকের একদম শুরুতে, ১৯০৭ সালে প্রথম চালু হয়েছিল ডাউন স্টিট টিউব স্টেশনটি। প্রায় ২৫ বছর চলার পর ১৯৩১ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় এই স্টেশন। ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে আরও একটি স্টেশন থাকার কারণেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল লন্ডন প্রশাসন। তারপর বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর আবার সাময়িকভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল ডাউন স্ট্রিট।
১৯৪০ সাল সেটা। জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। কিন্তু নাৎসি সেনাদের সঙ্গে কোনোভাবেই যুত করে উঠতে পারছে না দু’দেশের যৌথ বাহিনী। এরই মধ্যে খোদ লন্ডনের বুকে বোমাবর্ষণের কথা ঘোষণা করা জার্মানি। জার্মানিতে সেসময় একাধিক সামরিক বাঙ্কার থাকলেও, সেই ধরনের কোনো পরিকাঠামোই ছিল না লন্ডনে। ফলে সাধারণ মানুষ তো বটেই, প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল খোদ রাজপরিবারের সদস্যদের। কেননা বাকিংহাম প্যালেসও যে বোমা-প্রতিরোধী নয়। তবে উপায়? সেই সমাধান দিয়েছিলেন খোদ উইনস্টন চার্চিল। পরিত্যক্ত টিউব স্টেশনটিকেই তিনি নতুন রূপ দেওয়ার নির্দেশ দেন লন্ডন প্রশাসনকে।
আরও পড়ুন
ফিরছে ‘শয়তানের শ্বাস’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্রই হাতিয়ার দুষ্কৃতিদের
সেই পরিকল্পনা মতোই ৪০ জন শ্রমিকের রাতদিনের পরিশ্রমে সামরিক ঢঙে সেজে উঠেছিল ডাউন স্ট্রিট। মাটির ৭৩ ফুট নিচে গড়ে উঠেছিল অলিখিত ব্রিটিশ বাঙ্কার। সেখানেই স্থাপিত হয়েছিল রেলওয়ে এক্সিকিউটিভ কমিটির নতুন সদর দফতর। বলতে গেলে যুদ্ধ পরিচালনের কাজ চলত সেখান থেকেই। আন্ডারগ্রাউন্ড অফিস থেকে সামরিক বাহিনী এবং চার্চিলের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করতেন রেলওয়ের আধিকারিকরা। তবে নিরাপদ হলেও খুব কিছু সহজ ছিল না তাঁদের কাজ। অন্ধকারাচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাঁতে ঘরেই কাজ করতে হত দিনে ১২ ঘণ্টা। তারপরেও সূর্যালোক দেখার সুযোগ হত দীর্ঘ ১২-১৪ দিন অন্তর।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ময়দান থেকে ‘নিখোঁজ’, ৭৮ বছর পর পাওয়া গেল সৈনিকের মৃতদেহ
বিশ্বযুদ্ধে একাধিকবার জার্মান বোমাবর্ষণের সময় এই অফিসে এসেই আশ্রয় নিতেন উইনস্টন চার্চিল। নাৎসি বিমানহানার সময় একটানা বেশ কয়েকদিন সময় কাটাতেন এই পাতালপুরীতে। তাঁর জন্য অবশ্য আড়ম্বরের ব্যবস্থা থাকত আলাদা। মজুত রাখা হত তাঁর প্রিয় পেরিয়ার-জুয়েট শ্যাম্পেন কিংবা ১৮৬৫ ব্র্যান্ডি। অন্যদিকে ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম বরাদ্দ ছিল লন্ডনবাসীদের জন্য। সাইরেন বেজে উঠলেই খুলে দেওয়া হত স্টেশনের সদর দরজা।
আরও পড়ুন
নাৎসিদের হাতে লুঠ হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে, নিলামে ভ্যান গঘের আঁকা সেই ছবিই
বিশ্বযুদ্ধের পরই প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় ডাউন স্ট্রিটের। পরিত্যক্ত তকমা গায়ে নিয়েই এতদিন জীর্ণাবস্থায় পড়ে ছিল এই ঐতিহাসিক টিউব রেল স্টেশন। এবার লন্ডন প্রশাসনের উদ্যোগে সংরক্ষিত হল সেই হারানো ইতিহাস। উইনস্টন চার্চিলের ব্যবহৃত সামগ্রী, বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সেনা এবং রেল আধিকারিকদের যাপনচিত্র, যুদ্ধে সংযোগস্থাপনের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্র ইত্যাদি সামগ্রীর দেখা মিলবে এই পাতাললোকে। তা যে খুব আহামরি কিছু, তেমনটা একেবারেই নয়। তবে এই টানেলই যেন খোদ লন্ডনের ইতিহাসের অনন্য এক চরিত্র…
Powered by Froala Editor