হতে পারতেন পেশাদার সঙ্গীতশিল্পীও; ভালোবেসেই সন্তুষ্ট বুদ্ধদেব

‘এই সময়ের যুবক-যুবতীরা ক্ল্যাসিকাল মিউজিকে আগ্রহী নয় কেন?’ – এই ছিল সেদিনের সেমিনারের বিষয়। রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমির আয়োজনে সেবার কলকাতা শহরে এসেছেন দেশের তাবর তাবর শিল্পীরা। এসেছেন ভীমসেন যোশী। কলকাতার শিল্পীরা তো রয়েছেনই। সেই সময় রাজ্য সঙ্গীত অ্যাকাডেমির সদস্য বুদ্ধদেব গুহ। সাহিত্যিক হিসাবে নাম করে গিয়েছেন ততদিনে। কিন্তু সেই মানুষটা যে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে অথবা ফরেস্ট বাংলোর নির্জন ঘরে খালি গলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গেয়ে যান, সেই খবর রাখতেন খুব কম মানুষই। যাঁরা জানতেন, তেমনই কয়েকজন অনুষ্ঠানের আগের দিনের পার্টিতে জোর করলেন গান শোনানোর জন্য। বুদ্ধদেব গুহ গাইবেন নিধুবাবুর টপ্পা। খানিকটা নিমরাজি হয়েই শেষ পর্যন্ত গান ধরলেন তিনি। একটানা আধ ঘণ্টা গেয়ে চললেন।

পরেরদিন অনুষ্ঠান শুরু হল যথারীতি। কফি ব্রেকে চুপচাপ বসে আছেন বুদ্ধদেব গুহ। হঠাৎ দেখলেন, দূর থেকে হেঁটে আসছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সোজা লেখকের কাছে এসে প্রশংসা করলেন তাঁর আগেরদিনের গানের। বুদ্ধদেব গুহ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসসিক্ত ভঙ্গিতে শুধু বলেছিলেন, “একটা কাগজে লিখে দিন না, বুকে বাঁধিয়ে রাখি!” গানের প্রশংসা পেয়েছেন মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কাছেও। মান্না দে তো তাঁকে গানকে পেশা হিসাবেও বেছে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু এক জীবনে আর কতটুকুই বা সম্ভব হয়? সফল বাঙালি চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্টের পেশা সামলানোর পাশাপাশি অন্যতম জনপ্রিয় লেখক। আবার শিকার থেকে খেলাধুলো, সবেতেই তাঁর আগ্রহ। মন দিয়ে খেলাধুলো করলে তিনি লিয়েন্ডার পেজের সমকক্ষ হতে পারতেন বলেও বিশ্বাস করতেন। তবে সবকিছুর পরেও সঙ্গীতের কাছে তাঁকে ফিরতে হয়েছে বারবার।

ছোট থেকেই পুরাতনী গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। এক সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে ভর্তি হয়েছিলেন ‘দক্ষিণী’-তেও। তবে বাবার ইচ্ছে ছেলে অ্যাকাউন্টেন্সি নিয়ে পড়বে। তাই গান শেখা ছেড়ে দিতে হয় মাঝপথেই। কিন্তু গানটা থেকে যায় তাঁর জীবনে। এই ‘দক্ষিণী’-তেই আলাপ ঋতুর সঙ্গে। ঋতু গুহ, জীবনসঙ্গিনী। পাশাপাশি তিনি একজন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিল্পীও। বুদ্ধদেব গুহ নিজেও রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছেন দেবব্রত বিশ্বাসের কাছে। পুরাতনী গান শিখেছেন চণ্ডীদাস মালের কাছে। এরপর দিলীপ মুখোপাধ্যায়, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীর কাছেও গান শিখেছেন তিনি। প্রত্যেকেই ছাত্রের গানের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু পেশাদার গায়ক করে তুলতে পারেননি তাঁকে।

এই বুদ্ধদেব গুহরও কিন্তু বেশ কয়েকটা অ্যালবাম রেকর্ড হয়েছে। হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হয়েছে নিধুবাবুর টপ্পার অ্যালবাম। আবার সা-রে-গা-মা প্রকাশ করেছে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত। তবে হাতে গোনা কয়েকটা রেকর্ডের বাইরে বৃহৎ অংশের শ্রোতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় সেভাবে হয়নি। মাঝে মাঝে বৈঠকী আড্ডায় হঠাৎ সুর ভাঁজতেন তিনি। বুদ্ধদেব গুহর বৈঠকী আড্ডাগুলো যেন তাঁর গানের জন্যই অনেক দর্শককে টেনে নিয়ে যেত। তবু আরেকটা পেশায় তিনি যাবেন না, এই জেদ বজায় রেখেছিলেন।

শেষ বয়সে শরীর ভেঙে গিয়েছিল। চোখের দৃষ্টিও প্রায় মুছে গিয়েছিল। নিজে কলম ধরে লিখতে পারতেন না একটা অক্ষরও। বই পড়তে পারতেন না, ছবি আঁকতে পারতেন না। ঋতুও ছেড়ে গিয়েছেন তাঁকে। সঙ্গী বলতে ছিল শুধু গান। বছর দুয়েক আগে, ২০১৯ সালেও ৮৪ বছরের বুদ্ধদেব গুহ মঞ্চে গান শুনিয়েছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী পূর্বা দামের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতেই সেদিন মঞ্চে গান গেয়েছেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানগুলো কি কোথাও সংরক্ষণ করে রাখা আছে? বুদ্ধদেব গুহ নিজেও কি মনে-মনে চাইতেন না, তাঁর লেখা এবং ছবির মতোই থেকে যাক গানগুলোও? হয়তো চাইতেন। হয়তো সময়ের অভাবই তাঁর মতো প্রতিভার প্রতিটা দিককে সমানভাবে বিকশিত হতে দিল না। এই আক্ষেপ থেকে যাবে চিরকাল।

তথ্যসূত্রঃ এবার একক গানের আসরে ৮৪ বছরের ‘গায়ক’ বুদ্ধদেব গুহ, সাক্ষাৎকারে অলোকপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, আজকাল পত্রিকা
লেখকদের বিয়ে করা উচিত নয় | বুদ্ধদেব গুহ, সাক্ষাৎকারে কবি তানিয়া চক্রবর্তী, বাংলা নিউজ ২৪

Powered by Froala Editor