১৮৮২ সাল। মাত্র পঁচিশ বছর আগে সিপাহী বিদ্রোহের তেজ সামলে উঠেছে ব্রিটিশরা। সেসব যেতে না যেতেই আরও একটা দুর্যোগ। এবার ভারতে নয়, মিশরে। সেইজন্যই বম্বের বন্দরে এসে ভিড়েছে যুদ্ধজাহাজ। শয়ে শয়ে ব্রিটিশদের সৈন্য এসে হাজির হল জাহাজে। আর তাঁদেরই মাঝে বসে ছিলেন এক বাঙালি। তিনি সৈন্য নন; একজন সামান্য করণিক বা কেরানি। একমনে দেখে চলেছেন চারিদিক। কয়েকদিন পরেই নতুন পরিবেশ, যুদ্ধ, হিংসা। অবশ্য তাঁরাই বা কোথায় শান্তি পাচ্ছেন? স্বাধীনতা পাচ্ছেন? এত কিছু ভাবতে ভাবতে জাহাজ দিল ছেড়ে। মিশরের যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন বাঙালি করণিক, শ্যামলাল মিত্র…
কথায় বলে, পায়ের তলায় সর্ষে। ঘুরতে যেতে কে না চায়! আর তা যদি বিদেশ হয়, তাহলে তো কথাই নেই। যারা যেতে পারছেন না, তাঁদের জন্য ভ্রমণ কাহিনি আছেই! কিন্তু শ্যামলাল মিত্রের কাহিনি ঠিক এই সুরে বাঁধা নয়। মিশরের উদ্দেশ্যে গবেষণা বা নিছক ভ্রমণের জন্য যাননি তিনি। গিয়েছিলেন ব্রিটিশাধীন ভারতের এক কেরানি হয়ে। যুদ্ধের প্রয়োজনেই দেশ থেকে অনেক ভারতীয় সৈন্যকে মিশরে পাঠিয়েছিল ইংরেজ সরকার। তাঁদের সঙ্গেই জাহাজে উঠেছিলেন শ্যামলাল। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেই মরু দুনিয়া। তাঁদের প্রতিবাদ, পরিবেশ সবকিছুই সেই যাত্রার মূল মন্ত্র হয়ে ওঠে। ঠিক দুই বছর পর, সেই দেখা থেকেই শ্যামলাল মিত্র লিখে ফেললেন একটি বই। বাংলায় মিশর ভ্রমণ নিয়ে এই প্রথম কোনো নথি বের হল। শ্যামলালও ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে রইলেন।
তবে কেবলই কি তিনি? সেই সময়টাই তো ছিল ইতিহাসের সন্ধিক্ষণ। কয়েক বছর আগেই সিপাহী বিদ্রোহ ব্রিটিশদের ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ভারতের মতো উপনিবেশকে হাতছাড়া করা যাবে না। সেনাবাহিনীতেও অঢেল বদল আনা হল। তবে ছবিটা এবার ধরা দিল আরও বড়ো ক্যানভাসে। একদিকে ভারত, অন্যদিকে ইংল্যান্ড। মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ। আর আফ্রিকার কথা এলে মিশর আসবে না, তা কি কখনও হয়? পিরামিড, স্ফিংস আর রহস্যের দেশ এই মিশর। তবে তখন সেখানে চলছে অন্য রাজনৈতিক সমীকরণ। ইতিমধ্যেই ১৮৬৯ সালের নভেম্বর মাসে খুলে গেল সুয়েজ খাল। এশিয়া আর ইউরোপের বাণিজ্যিক রাস্তাটা আরও সহজ হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই সেই দিকে নজর পড়ল ব্রিটিশদের। এশিয়ার এত বড়ো উপনিবেশ হাতছাড়া করা যায় নাকি! বরং সুয়েজ ব্যবহার করে বাণিজ্যটাকে আরও শক্তপোক্ত করতে হবে। ছড়িয়ে দিতে হবে ব্রিটিশ রাজপতাকা। সেইসঙ্গে মিশরের ওপরও একটু ছড়ি ঘোরানো যাবে…
আর ঠিক এখানেই তাঁদের বিরোধ বাঁধল ফ্রান্সের সঙ্গে। তাঁদেরও লক্ষ্যটি যে এক! ব্যস, দুই পক্ষে চলল রেষারেষি। আর সেসবের রেশ পড়ল মিশরে। যে করেই হোক মিশরকে হাতে রাখতে চায় ইংল্যান্ড। ফরাসিরাও ছেড়ে দেবেন না। মাঝখান থেকে বিপদে পড়লেন মিশরের বাসিন্দারা। এই সময়ই উঠে এলেন আহমেদ উরাবি পাশা। তাঁর নেতৃত্বে একত্রিত হলেন মিশরীয়রা। আলেকজান্দ্রিয়ার বুকে জ্বলল আগুন। এবং বিদ্রোহ দমন করতে ভারত থেকে বিপুল সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিটিশ প্রশাসন।
আরও পড়ুন
বাংলায় নামকরণ ডাইনোসরের, আবিষ্কারের সঙ্গেও জড়িয়ে দুই বাঙালি
এই ছিল চালচিত্র। আর এমন পরিস্থিতির মধ্যেই এসে পড়লেন শ্যামলাল মিত্র। বম্বের বন্দর থেকেই সেই যাত্রা শুরু করেছিলেন তিনি। এক এক করে সেনারা জাহাজে উঠছে; আর তাঁদের মা, বোন, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয়রা নিচে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। কজন ফিরে আসবেন, কেউ জানেন না। ইংরেজদের যুদ্ধে প্রাণের বাজি রেখে যাচ্ছেন পরাধীন ভারতের সৈন্যরা, এটা কতটা সঠিক? প্রশ্ন আসে শ্যামলালের। দেখতে দেখতে জাহাজও ছেড়ে দেয় নির্দিষ্ট সময়।
আট দিন পর জাহাজ হাজির হয় আডেনে। জাহাজিরা বলে ‘ভারতের প্রবেশদ্বার’। এখান থেকে সুয়েজ যাওয়ার পথেই মারা গেলেন এক ব্যক্তি। এতদিনের সমুদ্রযাত্রা অনেকেরই সহ্য হচ্ছিল না; অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য এই মানুষটির সহায় হল না। শ্যামলাল দেখলেন, জাহাজের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে তাঁরই সন্তান। সেসব পেছনে ফেলে হাজির হলেন মিশরের যুদ্ধক্ষেত্রে। বিষাক্ত মাছির থেকে রক্ষা পেতে পরনে বিশেষ পোশাক। যেখানেই তাকাচ্ছেন, ভাঙাচোরা দৃশ্য স্বাগত জানাচ্ছে শ্যামলালকে। আর মাটির ওপর পড়ে আছে মৃতদেহ। সেনাদের মাথায় একটাই চিন্তা- উরাবি পাশা।
আরও পড়ুন
ডিঙি নৌকায় আন্দামান পাড়ি, উত্তাল সমুদ্রকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়লেন বাঙালি অভিযাত্রী
আলেকজান্দ্রিয়ার যুদ্ধে অসংখ্য ইংরেজকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন উরাবি পাশা। পুরুষ তো বটেই; স্ত্রী-শিশু-বৃদ্ধ কাউকে বাদ দেননি। সেই বৃত্তান্ত তখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আর কাসাসিনের যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে শ্যামলাল মিত্রের মনে পড়ছে কয়েক বছর আগে, কানপুরে ঘটে যাওয়া এরকমই একটি হত্যালীলা। সিপাহী বিদ্রোহের রোষের সামনে পড়ে মারা গিয়েছিলেন নিরীহ ইংরেজরা। শ্যামলাল মিত্র ভাবছেন, ভারত আর মিশর যেন এই জায়গায় এসে মিলে গেল একেবারে। দুই দেশই স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। কিন্তু তাঁরাই একই ভুল করল। কানপুরের সিপাহীদের মতো উরাবি পাশার হাতেও তো সেই নিরীহ রক্ত লেগে গেল। এই স্বাধীনতা তাহলে কীসের? যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও শ্যামলালের চিন্তায় নিজের দেশ। কখনও সেই চালচিত্রে উঠে আসছে মহাভারত, কখনও পুরাণ।
ইংরেজদের সৈন্য ও রণকৌশল পাশাদের থেকে অনেক শক্তিশালী ছিল। কাজেই কাবু করে ফেলাটা খুব একটা কঠিন ছিল না। আর ইংরেজ বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন গার্নেট উলসেলি। তাঁর নেতৃত্ব, যুদ্ধ পরিচালনা ও দক্ষতা মুগ্ধ করেছিল শ্যামলাল মিত্রকেও। সেইসঙ্গে উরাবি পাশার অক্লান্ত ও মরিয়া চেষ্টার দৃশ্যও ভোলেননি কখনও। নিজের দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার লড়াই তো তাঁর দেশের মানুষরা ও লড়ছে। আর পরাজিত উরাবি পাশার সেই ছবি দেখে একবারও কি মনে পড়েনি হাজার হাজার ভারতীয়ের মুখ? স্রেফ বাণিজ্যের বিস্তার আর ক্ষমতা বাড়ানোর এই প্রদর্শন কি আদৌ দরকার ছিল? নিজের লেখায় এই পুরো ঘটনাকে ‘মিশর যুদ্ধাভিনয়’ বলেও উল্লেখ করেছেন শ্যামলাল মিত্র। মিশরের শূন্য মরুভূমি ভেসে গিয়েছিল নিজের সন্তানদের রক্তে। সেই স্মৃতি কি কখনও ভুলতে পেরেছিলেন শ্যামলাল? কী করে পারবেন! নিজের দেশ, ভারতবর্ষই তো সেই শেকলে বন্দি…
আরও পড়ুন
বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দেবেন ওষুধ; পাক বিমান অপহরণের চেষ্টা ফরাসি যুবকের
তথ্যসূত্র- ‘মিশরযাত্রী বাঙ্গালী’ / শ্যামলাল মিত্র
Powered by Froala Editor