শুটিং ফ্লোরে রীতিমতো অধৈর্য হয়ে উঠছেন ছবি বিশ্বাস। মাথার ঘাম মুছছেন পরিচালক অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়ও। এখন ছবি বিশ্বাস যদি সিনেমা করবেন না বলে বেঁকে বসেন, তাহলেই সর্বনাশ। কিন্তু একজন অভিনেতা যে তখনও অনুপস্থিত। কী করা যায়? অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত ক্যামেরার পিছন থেকে ডেকে নিলেন সহকারী পরিচালককে। তাঁকেই অভিনয় করতে হবে। প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও অবশেষে রাজি হলেন সহকারী পরিচালক। ক্যামেরার পিছনে গিয়ে অর্ধেন্দু বিশ্বাস বললেন। ‘লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন’।
শুটিং শুরু হল। নবাগত অভিনেতার সংলাপ মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন সকলে। কিন্তু হঠাৎ পরিচালক চিৎকার করে উঠলেন। ‘কাট, কাট’। এ কেমন ঘটল? ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে সংলাপ ভুলে গেলেন স্বয়ং ছবি বিশ্বাস? হ্যাঁ, এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনাই ঘটেছিল ‘যোগ বিয়োগ’ সিনেমার ফ্লোরে। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় দেখে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলেন ছবি বিশ্বাস। আর সেই বিস্ময়ে নিজের সংলাপই ভুলে গিয়েছিলেন। আর সেইসঙ্গে টলিউডের জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটল এক নতুন চরিত্রাভিনেতার। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
‘যোগ বিয়োগ’ সিনেমার শুটিং চলাকালীনই ডাক এল স্বয়ং ঋত্বিক ঘটকের কাছ থেকে। অবশ্য তিনিও তখন নাটকের মঞ্চ থেকে সদ্য সিনেমার জগতে পা রেখেছেন। ‘নাগরিক’ সিনেমার জন্য একটি চরিত্রে বেছে নিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়কে। এরপর ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গেই একের পর এক সিনেমায় কাজ করেছেন। ‘মেঘে ঢাকা তারা’, বা ‘কোমল গান্ধার’-এর কথা কি ভোলা যায়? প্রাণখোলা সেইসব চরিত্র যেমন ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনই সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ সিনেমায় ডুবে গেলেন আপামর মধ্যবিত্ততায়। যে মানুষ নিজের স্ত্রীকে পর্দানসীন করে রাখতে চান। মিথ্যা সন্দেহ করেন স্ত্রীকে। সম্পূর্ণ বিপরীত সেই চরিত্রেও কোনো অসংগতি নেই। খাঁটি চরিত্রাভিনেতার মতোই মনস্তত্ত্বের প্রতিটা পরত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন।
সারা জীবনে অসংখ্য সিনেমায় কিন্তু তাঁকে বারবার চরিত্রাভিনেতা হিসাবেই পেয়েছি। নায়কের চরিত্রে অভিনয় করতে তেমন পছন্দ করতেন না। আর রোমান্টিক নায়ক হলে তো নয়ই। একবার নাকি এক প্রযোজক তাঁকে নিয়ে রীতিমতো ঝুলোঝুলি শুরু করেছিলেন। অনিল চট্টোপাধ্যায় বলেন, তিনি রোমান্টিক নায়কের চরিত্রে অভিনয় করবেন না। তেমন চরিত্র ওনার ভালো লাগে না। কিন্তু প্রযোজক ভাবেন, হয়তো পারিশ্রমিকের জন্যই তিনি রাজি হচ্ছেন না। শেষে উত্তম কুমারের চেয়েও বেশি পারিশ্রমিক হাঁকেন। তখন অনিল চট্টোপাধ্যায় খানিকটা ইতস্তত করে মাথা নেড়ে জানান, তাঁর যা পারিশ্রমিক তাই দিলেই হবে। তবে অভিনয়টা তিনি করে দেবেন।
আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পুরো জীবনটাই ছিল খামখেয়ালি। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে যখন জার্মান কোলাবরেশনের একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন, তখন মাইনে ছিল ৭০০-৮০০ টাকা। তখনকার দিনে টাকাটা রীতিমতো বেশি। কিন্তু অনিল চট্টোপাধ্যায় হঠাৎ বলে বসলেন, সেই কাজ তাঁর ভালো লাগছে না। দূর সম্পর্কের আত্মীয় অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় তখন পরিচালক। তাঁর সহকারী হয়েই ঢুকে গেলেন টলিউডে। মাইনে মাসে ৫০ টাকা। এক ধাক্কায় উপার্জন দাঁড়াল মোটামুটি ৮ শতাংশে। কিন্তু ওই যে, কাজের মধ্যে আনন্দ আছে।
বছর দশেক বয়সে পিতৃবিয়োগের পর অনিল চট্টোপাধ্যায় চলে গিয়েছিলেন দিল্লিতে। ফলে বাংলাটা তেমন সড়গড় ছিল না। ক্যামেরার সামনে প্রথম প্রথম আসতেও তাই একটু অস্বস্তিই হত। কিন্তু যখন তাঁকে পর্দায় দেখা গেল, সেই জড়তা ততদিনে কেটে গিয়েছে। এমনকি একসময় আকাশবাণীর সঞ্চালকের পদেও যোগ দেওয়ার ডাক পেলেন তিনি। ইন্টারভিউতে শতাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু আসন একটাই। আর সেই একটি আসনেই ডাক পেলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। যদিও সিনেমার কাজে ব্যস্ত থাকায় কাজে যোগ দিতে পারলেন না। তাঁড় বদলে কাজে যোগ দিলেন দ্বিতীয় স্থানে থাকা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন
৩৬০টি সিনেমায় অভিনয়, কমেডিয়ানের ‘অভিশাপে’র মধ্যেও জাত চিনিয়েছেন অনুপকুমার
সেদিন ইন্টারভিউ দিতে গিয়েই বন্ধুত্ব জমে উঠেছিল দুই চাটুজ্জ্যের। তারপর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও চলে এলেন সিনেমার ফ্লোরে। তবে তিনি প্রথম থেকেই নায়ক। আর অনিল চট্টোপাধ্যায় সারা জীবন নিজেকে পার্শ্বচরিত্রেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন। কিন্তু বন্ধুত্বে ছেদ পড়েনি কোনোদিন। এমনকি প্রাণখোলা মানুষটির সঙ্গে বন্ধুত্বে মেতে উঠেছিলেন উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া চৌধুরীর মতো নায়ক-নায়িকারাও। তবু যেন স্টারডমকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সারা জীবন কাটিয়ে দিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়। জনপ্রিয়তার কথা ভুলে গিয়ে আড্ডায় মেতে উঠতেন বসুশ্রী কফি হাউসে। একবার সেখানেই পাশ দিয়ে যাচ্ছিল উত্তমকুমারের গাড়ি। হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে আছেন উত্তমকুমার। কেউ চিনে ফেললেই যে ভিড় জমে যাবে। হঠাৎ কেউ যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই যে গুরু! এদিকে একটু তাকাও।’ আর উত্তমকুমারও হঠাৎ এমন চিৎকারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে দেখেন, অনিল চট্টোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে।
উত্তমকুমার বলেছিলেন, একটু আড়াল রাখতে শিখতে। কিন্তু অনিল চট্টোপাধ্যায় সেসব কথায় পাত্তা দেননি। তিনি তো তারকা নন। তিনি শিল্পী। অভিনয়-শিল্পী।
আরও পড়ুন
শুধু বাংলাই নয়, একাধিক হিন্দি সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন ছবি বিশ্বাস
তথ্যসূত্রঃ ওর মতো ছেলেমানুষ খুব একটা দেখিনি, অনুভা চট্টোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
একসঙ্গে অভিনয় করেও ‘অচেনা’, ঋত্বিক ঘটককে তাড়িয়ে দিলেন উৎপল