সে এক সময় ছিল। যখন কথায়-কথায় অস্ত্র উঠে আসত হাতে। কেউ আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলেছে কিংবা কারোর জন্য আত্মসম্মান ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হত ডুয়েল (Duel)! হাত থাকতে আইনের কী দরকার? প্রতিদ্বন্দ্বীকে সম্মুখসমরে হারিয়েই পাওয়া যেত প্রকৃত ‘ন্যায়বিচার’। সেসব প্রথা উঠে গেছে কয়েকশো বছর আগে। কিন্তু না, ইতিহাস বলছে অন্য কথা। শেষ আনুষ্ঠানিক দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়েছিল মাত্র সাতান্ন বছর আগে। তাও ফ্রান্সের (France) দুই বিখ্যাত মানুষের মধ্যে। নেহাৎ মজার ছলে নয়, তলোয়ারের খোঁচায় বিরোধীপক্ষকে রীতিমতো আহত করে তবে থেমেছিল এই লড়াই।
শুরুটা অবশ্য হয়েছিল বাগযুদ্ধ দিয়েই। ১৯৬৭ সালের ঘটনা। ফ্রান্সের পার্লামেন্টে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন মার্সেই শহরের মেয়র গ্যাস্তঁ দেফের (Gaston Defferre) এবং বিরোধীপক্ষের রাজনীতিবিদ রেইনে রিবিইরে (Rene Ribiere)। ক্রমশ বাড়তে থাকে উত্তেজনার পারদ। একটা সময় ধৈর্যচ্যুতি ঘটে দেফের সাহেবের। রাগের মাথায় তিনি রেইনে-কে বলে বসেন, “শাট আপ, স্টুপিড!” কথাটা অবশ্য বলেছিলেন ফরাসিতেই। তবে ভাষা বদলালেও অপমানের ঝাঁঝ কমে না। রেইনে সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা চাইতে বলেন মেয়রকে। কিন্তু তিনিও এক কথার মানুষ। যা বলেছেন, বেশ করেছেন। ক্ষমা তিনি চাইবেন না।
ভরা সভায় এত বড়ো অপমান সহ্য করার লোক রেইনেও নন। মানহানির মামলা অবশ্য করতে পারতেন, তবে তিনি বেছে নিলেন একটি পুরনো পদ্ধতি। তলোয়ারের দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করে বসেন দেফের-কে। ১৯৬৭-র ২১ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয় ডুয়েল-এর দিনক্ষণ। উভয়পক্ষই সেকেন্ড বা আম্পায়ার হতে অনুরোধ করেন জন দে লিপকোওস্কিন-কে। তিনি আবার ওই সময়ের ফ্রান্সের বিদেশমন্ত্রকের প্রধানকর্তা। স্থান ঠিক হয় পশ্চিম প্যারিসের ন্যুই-সুর-স্যেন-এর ((Neuilly-sur-seine) একটি ব্যক্তিগত প্রাসাদের পিছনের অংশে। ছিলেন একজন ক্যামেরাম্যানও। যিনি পুরো দ্বৈরথ ভিডিও করে রেখেছিলেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। আর সম্ভবত এটিই ক্যামেরাবন্দি একমাত্র ডুয়েল।
এদিকে ডুয়েলের পরদিন, মানে ২২ তারিখ আবার রেইনে-র বিয়ে। দেফের জানতেন সেই খবর। কিন্তু রেইনে জানতেন না যে মেয়র সাহেবের তলোয়ারের ধার কত তীক্ষ্ণ। একসময় নিয়মিত ফেন্সিং-চর্চা করতেন তিনি। বয়সেও তিনি প্রায় ১২ বছর বড়ো। আর জানতেন না বলেই রেইনে দুজনের অস্ত্র হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন ইপেস তলোয়ার। যা অত্যন্ত ধারালো বলে বিখ্যাত ছিল। লড়াই যে প্রাণঘাতী হবে না, এটা পূর্বনির্ধারিত ছিল। তবে অন্তত একাধিকবার আঘাত বা রক্তপাত না হওয়া পর্যন্ত চলবে ডুয়েল। এই নিয়মটা অবশ্য রেইনে-ই করেছিলেন। শুনে কি একটু মুচকি হেসেছিলেন দেফের? কারণ তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, এমনভাবে প্রতিপক্ষের হাতে আঘাত করবেন, যাতে তিনি পরদিন বিয়ের কেক না কাটতে পারেন!
আরও পড়ুন
বিবাহবিচ্ছেদের জন্য মরণপণ ডুয়েল লড়তে হত স্বামী-স্ত্রীকে! মধ্যযুগের এক বর্বর প্রথা
যথাস্থানে, যথাসময়ে শুরু হল তলোয়ারের দ্বন্দ্ব। দেফের-র সঙ্গে কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিলেন না রেইনে। শুরুতেই ডান হাতে একবার খোঁচা খান তিনি। রাগ চড়তে থাকে তাঁর মাথায়। চার মিনিটের মাথায় আবার প্রায় একই জায়গায় আঘাত করেন দেফের। শুরু হয় রক্তপাত। ব্যাস, নিয়ম অনুসারে সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় ডুয়েলের। বিজেতার নাম গ্যাস্তঁ দেফের। প্রতিজ্ঞা ও আত্মসম্মান দুইই রেখেছিলেন তিনি। তবে পরদিন রেইনে সাহেবের কেক কাটতে কোনো অসুবিধা হয়েছিল কিনা, সে ব্যাপারে ইতিহাস নীরব। নিমন্ত্রিতের তালিকায় দেফের সাহেব ছিলেন না, এটুকু অনুমান করাই যায়।
আরও পড়ুন
২৪০ বছর আগে, আজকের দিনেই কলকাতায় ডুয়েল লড়েছিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ দুই সাহেব
পরবর্তীতে দুজনের সম্পর্ক আরো অবনতির দিকে চলে যায়। দেফের মারা যান ১৯৮৬ সালে এবং রেইনের মৃত্যু ঘটে ১৯৯৬-তে। শোনা যায়, এরপর আর তাঁদের মধ্যে নাকি বাক্যালাপও হয়নি। অনেকের অবশ্য মনে পড়তে পারে তারিণী খুড়োকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের ‘লখ্নৌর ডুয়েল' গল্পটি। তবে সেখানে সবাই ছিল অশরীরী। পিছন থেকে কলকাঠিও নেড়েছিলেন অন্য একজন। আর এখানে তো সবাই রীতিমতো সমাজপ্রসিদ্ধ ব্যক্তি। কলমের এক খোঁচায় বদলে দিতে পারতেন দেশের আইনকানুন। তাঁরাও কিনা শেষ পর্যন্ত বেছে নিয়েছিলেন ডুয়েলের পদ্ধতি। সব আয়োজন দেখে মনে হতে পারেই যে, এঁরা আরেকটু সচেষ্ট হলে একটি প্রাচীন প্রথাকে আবার আইনসিদ্ধ করে দিতে পারতেন!
Powered by Froala Editor