মাত্র চার দশক আগে শেষ মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল গিলোটিনে

ফ্রান্সের (France) মার্সেই শহরের কারাগারে সেদিন প্রবল নিরাপত্তা। খুনসহ একাধিক অপরাধে অভিযুক্ত হামিদা জানদৌবি (Hamida Djandoubi) নামের এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে সেখানে বন্দি। মৃত্যুদণ্ডের সাজা হয়েছে তার। গিলোটিনের (Guillotine) মাধ্যমে ধড় থেকে আলাদা হয়ে যাবে মাথা। গোপনীয়তার সঙ্গে অপরাধীকে নিয়ে আসা হল যন্ত্রটির সামনে। জল্লাদের হাতে নিপুণভাবে সম্পন্ন হল কাজ। টের পেল না কাকপক্ষীতেও। এ আর নতুন কী? আঠারো শতকের ফ্রান্সে তো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত এভাবেই। কিন্তু এই ঘটনা দুশো বছর পুরনো নয়। জানদৌবির মৃত্যুর সময় পৃথিবীতে এসে গেছে পারসোনাল কম্পিউটার। মানুষ পৌঁছে গিয়েছে চাঁদে। খোদ ভারতে ‘শোলে’ সিনেমা মুক্তির দু’বছর কেটে গেছে। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ১৯৭৭ সালে ফ্রান্সে শেষবারের মতো কাজ করেছিল গিলোটিন। পঞ্চাশ বছরও হয়নি সে ঘটনার।

গিলোটিনের নাম তো ইতিহাস বইতে পড়েছি সকলেই। ফরাসি বিপ্লবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে এর গল্প। কাঠের তৈরি একটি যন্ত্র। শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষের মাথাটি পেতে দেওয়া হবে তার মাঝে। উপর থেকে নেমে আসবে ধারালো লোহার পাত। ব্যাস, কষ্টবিহীন এক মৃত্যু। অন্তত প্রথমে গিলোটিন ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেওয়া হত এই যুক্তি। তার আগে ইউরোপে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পদ্ধতিগুলির চেয়ে হয়তো ‘আরামদায়ক’ ছিল গিলোটিনের কাজকর্ম। তখন কাঠের চাকায় দুদিকে বেঁধে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া হত দেহ। কিংবা জল্লাদের অস্ত্র নেমে আসত কাঁধের উপরে। দীর্ঘদিন ব্যবহারে সেগুলি এমনই ভোঁতা হয়ে যেত যে, বেশ কয়েকবার আঘাত না করলে ঘাড় থেকে মাথা নামত না। সব দিক বিবেচনা করে ফরাসি চিকিৎসক জোসেফ ইগনেস গিলোটিন বিকল্প ব্যবস্থার প্রস্তাব রাখলেন। যন্ত্রের নামও রাখা হল তাঁর নামেই। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইয়ের সম্মতিতে উদ্বোধন হল তার। ঘটনাচক্রে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে তাঁর মাথাটিও বিসর্জন গেছিল গিলোটিনেই।

সেটা ১৭৯৩ সালের কথা। শেষ যবনিকা পড়তে লেগে গেল প্রায় ২০০ বছর। হামিদা জানদৌবি অপরাধী হিসেবে ছিল যথেষ্ট বিপজ্জনক। জন্মসূত্রে তিউনিশিয়ার এই ব্যক্তি ১৯৬৮ সালে পাকাপাকিভাবে চলে আসে মার্সেইতে। প্রথমে কাজ করত দোকানে। ১৯৭১-এ একটি দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম হয় তার ডান পা। বাদ পড়ে যায় দুই-তৃতীয়াংশ। হাসপাতালেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় এলিজাবেথ বোসকেট নামের ২১ বছর বয়সী একটি মেয়ের সঙ্গে। কিছুদিন একসঙ্গে চলল ঘরসংসার। কিন্তু পায়ের জন্য কাজ পায় না, পকেটে পয়সা নেই। ক্রমে তিক্ত হতে থাকল হামিদার মেজাজ। বাড়ে মদ্যপানের মাত্রা। ১৯৭৩-এ এলিজাবেথ দ্বারস্থ হয় পুলিশের। অভিযোগ, অর্থের জন্য হামিদা তাকে বাধ্য করছে গণিকাবৃত্তিতে। কদিন পুলিশে হেফাজতে থাকার পর ছাড়া পেয়ে যায় হামিদা। কিন্তু মনের মধ্যে পুষে রাখে রাগ। পরের বছরের জুলাই মাসে মেলে এলিজাবেথের মৃতদেহ। যন্ত্রণা দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। 

অপরাধীকে চিহ্নিত করা কঠিন কাজ ছিল না একেবারেই। হামিদা প্রথমে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দেখিয়ে সহানুভূতি আদায় করতে চাইলেও, অপরাধের প্রকৃতি তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিল। ২৫ ১৯৭৭-এর ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষিত হল মৃত্যুদণ্ডের রায়। প্রেসিডেন্টের কাছে অনুরোধও প্রত্যাখ্যাত হয়। প্রথমে জানতে দেওয়া হয়নি মৃত্যুদণ্ডের পদ্ধতি। ১০ সেপ্টেম্বর খুব ভোরে হামিদার কাছে খোলসা করা হয় সমস্ত ব্যাপার। অবশেষে ভোর চারটে চল্লিশে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড হয় তার। জল্লাদের নাম ছিল মার্সেল শিভেলিয়ার। ভবিষ্যতের কাজের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য তার ছেলে এরিককেও উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল সেদিন। 

আরও পড়ুন
মৃত্যুর ৫ ঘণ্টা পর ‘জেগে’ উঠলেন মহিলা, আশ্চর্য ঘটনা ইকুয়েডরে

কিন্তু সৌভাগ্যবশত তারপর আর কাউকে গিলোটিনে প্রাণ দিতে হয়নি। ১৯৮১-তে চিরকালের জন্য আইনত বন্ধ করে দেওয়া হয় এই পদ্ধতি। এমনকী ফ্রান্স থেকে তুলে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। তাতে কিছুটা ভূমিকা রয়েছে হামিদার। ১৯৩৯-এ শেষবার সর্বসমক্ষে গিলোটিনে চড়ানো হয়েছিল এক খুনিকে। তারপর থেকে গোপনীয়তার সঙ্গেই চলত এই কাজ। যদিও, ‘বর্বর’ প্রথা বন্ধ করার দাবি তীব্র হচ্ছিল জনতার মধ্যে। উপস্থিত ডাক্তারদের বয়ান অনুযায়ী, মৃত্যুর পর নাকি ছটফট করেছিল হামিদা। যা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে সর্বস্তরে। তারপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় গিলোটিন নিষিদ্ধ করার। নিজে কবরে গিয়েও কিন্তু হামিদা শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিল গিলোটিনের কবরে।

আরও পড়ুন
ইউরোপজুড়ে ছাপা হত ‘বিষাক্ত বই’, দীর্ঘদিনের ব্যবহারে হতে পারে মৃত্যুও

Powered by Froala Editor