জীবিত প্রাণীকে পাথরে পরিণত করে এই হ্রদ! কীভাবে?

রক্তের মতো টকটকে লাল রং হ্রদের জলের। আর তার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য পাথরের তৈরি পাখির মূর্তি। বাদুড় বা ছোটো স্থলচর প্রাণীরাও বাদ যায়নি। কিন্তু এইসব মূর্তির নির্মাতা আসলে কে? কেনই-বা জনহীন এই প্রান্তরে আশ্চর্য সব শিল্পকর্ম সাজিয়ে রেখে গেছেন তিনি? না, কোনো ব্যক্তি নন। বরং, এক্ষেত্রে শিল্পীর ভূমিকায় রয়েছে খোদ প্রকৃতিই। 

ওল্ডোনিও লেঙ্গাই। নামটার সঙ্গে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। ‘চাঁদের পাহাড়’-এ এই আগ্নেয়গিরির কথাই উল্লেখ করেছিলেন বিভূতিভূষণ। এই আগ্নেয়গিরির কাছেই শঙ্কর সন্ধান পেয়েছিল হিরের প্রকাণ্ড এক খনির। তবে ঘন অরণ্য, প্রতিকূল পরিবেশ আর হিংস্র ব্যুনিপের চোখ এড়িয়ে আরেকটু সন্ধান করলেই এই হ্রদের হদিশ পেত শঙ্কর। যদিও তাঞ্জানিয়ার আরুশা প্রদেশের এই পার্বত্য হ্রদ আবিষ্কৃতই হয়নি তখনও পর্যন্ত। ফলে, বিভূতিভূষণের লেখাতেও অধরা থেকে যায় এই হ্রদের কথা। 

২০১৩ সাল। তাঞ্জানিয়ার (Tanzania) অরণ্যে বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলতে তুলতেই আরুশা প্রদেশের ‘নেট্রন’ (Lake Natron) নামের এই হ্রদে পৌঁছে গিয়েছিলেন ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার নিক ব্র্যান্ড। সে-সময়ই তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই আশ্চর্য সব পাথরের মূর্তি। প্রাথমিকভাবে তিনিও ঠাহর করেছিলেন স্থানীয় কোনো উপজাতির মানুষ হয়তো পশুপাখিদের প্রতিকৃতি তৈরি করে স্থাপন করেছেন হ্রদের চারপাশে। তবে ভুল ভেঙেছিল কয়েক মুহূর্ত পরই। 

কোথায় মানুষজন? গোটা অঞ্চলে যে কোনো বসতিই নেই। সঙ্গে মূর্তিগুলোর আরেকটু কাছে যেতেই তিনি বুঝতে পারেন সেগুলি আদতে পাথরের মূর্তি নয়। বরং, প্রস্তরীভূত প্রাণীর মৃতদেহ। তখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ পাথরে পরিণত হয়নি এমন বেশ কিছু প্রাণীর দেহের নজিরও পান তিনি। নিজের তোলা এই ছবিগুলোই কিছুদিনের মধ্যে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা ইউরোপে। ‘অ্যালাইভ এগেইন ইন ডেথ’-নামের এই ফটোগ্রাফির সিরিজটি প্রকাশিত হয়েছিল একাধিক আন্তর্জাতিক পত্রিকাকেও। 

কিন্তু হঠাৎ কেন প্রস্তরীভূত হয়েছে তারা? নিকের তোলা ছবি প্রকাশ্যে আসার পরই অনুসন্ধানে নামেন গবেষকরা। আর জলের নমুনা পরীক্ষা করতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা যায়, এই হ্রদের তলদেশ আসলে লাভা ও আগ্নেয় পাথর দিয়ে তৈরি। আর তার কারণেই হ্রদের জলে মাত্রাতিরিক্তভাবে উপস্থিত নেট্রন এবং ট্রনা নামের দুটি বিশেষ রাসায়নিক যৌগ। এই যৌগুলির কারণেই হ্রদের জল টকটকে লাল। পাশাপাশি মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির জন্য নেট্রনের নামানুসারেই নাম রাখা হয় হ্রদের। 

সবমিলিয়ে এই দুই যৌগের কারণেই জলের পিএইচ মাত্রা প্রায় ১২-র কাছাকাছি। যা উচ্চ ক্ষার হিসাবেই পরিগণিত হয় রসায়নের জগতে। মূলত এই ক্ষারই জীবিত পাখিদের শরীর পরিণত করে পাথরের মূর্তিতে। এই জলে দীর্ঘক্ষণ কাটালে ধীরে ধীরে মারা যেতে থাকে দেহের চামড়ার কোশ। জমতে থাকে লবণের আস্তরণ। একটা সময় পরে, সম্পূর্ণভাবে লবণের সাদা আস্তরণে মুড়ে যায় পাখি বা প্রাণীদের দেহ। তবে শুধু পাখি নয়, এই হ্রদের জলে পা ডুবিয়া বসতে গেলে মানুষের ক্ষেত্রে অনর্থ ঘটতে পারে বলেই অভিমত বিজ্ঞানীদের। 

তবে মজার বিষয় হল, এতকিছুর পরেও এই হ্রদে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় এক বিশেষ প্রজাতির পাখি। নেট্রনের ‘খুনে’ জলও বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারে না তাদের ওপর। রেড ফ্লেমিঙ্গো। তাঞ্জানিয়ার কিছু প্রাচীন উপজাতির কথায়, এই হ্রদে শতকের পর শতক ধরে বসবাস করে আসছে ফ্লেমিঙ্গোরা। আজও এই হ্রদের ধারে ঘুরতে গেলেই দেখা যাবে, লম্বা লম্বা পায়ে হ্রদের জলে হেঁটে বেড়াচ্ছে তারা। জলজ প্ল্যাংটন এবং অন্যান্য ছোটো প্রাণীরাই তাদের শিকার। কিন্তু এই জলে কীভাবে বেঁচে থাকে তারা? সেই রহস্যের সমাধান মেলেনি আজও। অভিযোজনের ধারা মেনেই হয়তো এই জলে বেঁচে থাকার কোনো বিশেষ কৌশল আয়ত্ত করেছে তারা। আয়ত্ত করেছে ‘অহল্যা’-র দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার প্রতিষেধক ক্ষমতা। 

Powered by Froala Editor