মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলিস শহরের বুকেই প্রকাণ্ড এক হোটেল। হোটেল কর্টেজ। শত শত মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে নিত্যদিন। অথচ, এই কোলাহল, জনসমাবেশের আড়ালেই সেখানে ঘটে চলেছে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। নেপথ্যে এই হোটেলেরই মালকিন। এলিজাবেথ জনসন। অবশ্য সকলের কাছে তিনি পরিচিত 'কাউন্টেস' নামেই। আদতে তিনি ভ্যাম্পায়ার। যৌনতার প্রলোভন দেখিয়ে শিকার ধরেন তিনি। রেহাই পায় না শিশুরাও। আর তাদের রক্তপান করেই নিজের আয়ু বাড়িয়ে চলেন এলিজাবেথ। বছরের পর বছর পেরিয়েও ধরে রাখেন যৌবনের জৌলুশ।
২০১৫ সাল। সেঞ্চুরি ফক্স টেলিভিশনে প্রকাশ পেয়েছিল 'আমেরিকান হরর স্টোরি' সিরিজের পঞ্চম অধ্যায়, 'হোটেল'। প্রথমবারের জন্য অভিনয়ের জগতে পা দিয়েছিলেন সঙ্গীতশিল্পী লেডি গাগা। প্রধান অ্যান্টাগনিস্ট এলিজাবেথ 'কাউন্টেস'-এর চরিত্রেই অভিনয় করেছিলেন তিনি। প্রশংসিতও হয়েছিলেন যথেষ্ট। সেরা অভিনেত্রী হিসাবে পেয়েছিলেন গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড। অবশ্য আজকের গল্প এই সিরিজকে নিয়ে নয়। বরং, এই গল্পের নায়িকা আরেক এলিজাবেথ।
কাউন্টেস এলিজাবেথ ব্যাথোরি। ষোড়শ শতকের এই রক্তপিপাসু মহিলা জমিদারকে সামনে রেখেই তৈরি করা হয়েছিল লেডি গাগা অভিনীত 'হোটেল' সিরিজের এলিজাবেথ জনসনের চরিত্রটি। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, বাস্তব জগতের এই এলিজাবেথের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে নৃশংস ইতিহাস। তাঁর নামেও উঠেছিল ভ্যাম্পেয়ারিজম, ব্ল্যাক ম্যাজিকের অভিযোগ।
শুরু থেকেই বলা যাক গল্পটা। ১৫৬০ সালের ৭ আগস্ট। হাঙ্গেরির নাইরবাতোরের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম এলিজাবেথের। বাবা ছিলেন এই ছোট্ট এই হাঙ্গেরিয়ান প্রদেশের কাউন্ট। 'অত্যাচারী' দুর্নাম ছিল তাঁরও। কখনও খাজনা না পাওয়ায় দরিদ্র কৃষককে কখনও শূলে চড়াতেন তিনি, কখনও গুপ্তচর সন্দেহে গাধার পেটে ঢুকিয়ে জীবন্ত সমাধিস্থ করত সাধারণ মানুষকে। বাবার এই অত্যাচারী মেজাজই যেন জিনগতভাবেই আয়ত্ত করেছিলেন এলিজাবেথ।
এলিজাবেথের হত্যালীলা এবং নৃশংসতা শুরু হয় ১৫৯০ সাল নাগাদ। সে-সময় গোটা ইউরোপ ত্রস্ত অটোমান সাম্রাজের আক্রমণে। হাঙ্গেরিও বাদ যায়নি অটোমান-আক্রোশ থেকে। আর এই বহির্শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতেই রাজ্য ছাড়েন এলিজাবেথের স্বামী ফেরেঙ্ক নাদাসদি। হয়ে উঠেছিলেন সে-দেশের যুদ্ধনায়ক। অন্যদিকে জনশূন্য 'চেইতে প্রাসাদ'-এ দিন কাটাতে থাকেন কাউন্টেস এলিজাবেথ। সঙ্গী বলতে ছিল মাত্র ৪ জন পরিচারিকা। আর তাঁর এই নিঃসঙ্গতাই হয়তো জন্ম দিয়েছিল ইতিহাসের কুখ্যাত এক সিরিয়াল কিলারের।
এলিজাবেথের মনে বিশ্বাস জন্মায়, কিশোরী ও তরুণীর রক্তপান এবং সেই রক্তে স্নান করলে নাকি বৃদ্ধি পায় আয়ু। যৌবন ধরে রাখা যায় আজন্ম। আর এই বিশ্বাসেই একের পর এক হত্যাকাণ্ডে হাত রাঙিয়েছেন কাউন্টেস।
দরিদ্র কৃষক ও মধ্যবিত্ত পরিবারের কন্যারাই ছিল তাঁর মূল শিকার। প্রথমে পরিচারিকা হিসাবেই তাঁদের নিয়োগ করতেন এলিজাবেথ। কখনও আবার অভিজাত আদব-কায়দা শেখানোর লোভ দেখিয়েই ডাকতেন প্রাসাদে। তবে প্রাসাদে আনার পরই আসল রূপ ঝলসে উঠত তাঁর। চলয় নির্মম নির্যাতন। কখনও উত্তপ্ত লোহার শলাকার ছ্যাঁকা, কখনও আবার শরীরজুড়ে ধারালো ছোরার আঘাত কিংবা নখের নিচে সূচ ঢুকিয়ে দেওয়া। আবার হাড় কাঁপানো শীতে সম্পূর্ণ নগ্ন করেই বরফ-গলা জলে কখনও চুবিয়ে রাখতেন কিশোরীদের। এলিজাবেথের অত্যাচারের বর্ণনা হার মানায় আজকের দিনের রহস্য-রোমাঞ্চের সিনেমা-সিরিজকেও।
এলিজাবেথের এই পাগলামি আরও বাড়ে ১৬০৪ সালের পর থেকে। সে-বছরই অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে মৃত্যু হয় তাঁর স্বামীর। আর এই শোকই যেন আরও উন্মত্ত করে তোলে এলিজাবেথকে। শুধু দরিদ্র কিংবা মধ্যবিত্তই নয়, এরপর বহু উচ্চবিত্ত ও সম্ভ্রান্ত বাড়ির কিশোরীরাও শিকার হয়েছেন তাঁর। গোটা রাজ্যজুড়েই চর্চা শুরু হয়ে যায় রক্তপিপাসু কাউন্টেসকে নিয়ে। তবে তাতেও থামেননি তিনি।
১৬১০ সালে এলিজাবেথের এই নৃশংস কর্মকাণ্ডের খবর পৌঁছে যায় হাঙ্গেরির সম্রাট দ্বিতীয় ম্যাথিয়াসের কাছে। ব্যাপারটা তদন্ত করতে তিনি ভার দেন পার্শ্ববর্তী প্রদেশের কাউন্ট থুরজোকে। এই থুরজো আবার সম্পর্কে কাউন্টেস এলিজাবেথেরই ভাই। সৈন্য-সামন্ত নিয়েই তিনি হাজির হন এলিজাবেথের প্রাসাদে। ভাই হওয়ার সুবাদেই দুর্গের গোপন কক্ষে প্রবেশের অনুমতিও পেয়ে যান তিনি। তবে ভেতরে গিয়ে রীতিমতো চমকে উঠতে হয় কাউন্ট থুরজোকে।
কাঠের বেদীর ওপর শোয়ানো এক ১৪ বছর বয়সি কিশোরী। সম্পূর্ণ নগ্নগাত্র। তার শরীরজুড়ে অজস্র ফোস্কা, ক্ষত। আর এমন একটি দগদগে ক্ষত থেকে ঝরে পড়া রক্তই জিভ দিয়ে চেটে খাচ্ছেন তাঁরই দিদি! সেইসঙ্গে প্রাসাদ কাঁপানো অট্টহাসি। এমনকি থুরজো যে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর পাশে, সেই হুঁশই নেই তাঁর।
হ্যাঁ, সম্পর্কে দিদি হলেও, রাজদায়িত্ব থেকে সরে আসেননি থুরজো। গ্রেপ্তার করেছিলেন দিদিকে। সেইসঙ্গে তল্লাশি চালিয়ে প্রাসাদ থেকে উদ্ধার করেন প্রায় ৬৫০ পচা-গলা কিশোরীর মৃতদেহ এবং কঙ্কাল। উদ্ধার করেন ৩০০-র বেশি বন্দি কিশোরীকেও। অবশ্য এলিজাবেথের অত্যাচারে তারাও ধুঁকছে তখন। মজার বিষয় হল, আজও বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক সিরিয়াল কিলার হিসাবে গিনেস বুকের পাতায় নাম রয়েছে কাউন্টেস এলিজাবেথের।
যাই হোক, প্রাথমিকভাবে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় 'ব্লাড কাউন্টেস'-খ্যাত এলিজাবেথকে। খ্রিস্টান যাজক জানান, এলিজাবেথ আসলে ভ্যাম্পায়ার। কেউ আবার বলেন ব্ল্যাক ম্যাজিক অধ্যয়ন করে নিজের শরীরেই নাকি তিনি ধারণ করেছেন খোদ শয়তানকে। তবে বাস্তববাদী থুরজোর বিশ্বাস ছিল না এসবে। বরং, মৃত্যুদণ্ডের বদলে দিদিকে আরও কঠিন শাস্তি দেন তিনি। এলিজাবেথেরই রাজপুরীতে ছোট্ট একটি কুঠুরিতে বন্দি করেন তাঁকে। দরজা-জানলাগুলিও গেঁথে দেওয়া হয় পাথর দিয়ে। শুধু খাবার ও জল দেওয়ার জন্য রাখা হয় ছোট্ট একটি ফাঁক। আমৃত্যু সেখানেই নরকবাস করেছেন তিনি। মাশুল দিয়েছিলেন নিজের পাপের...
Powered by Froala Editor