পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীর রয়েছে ভারতেই, সন্ন্যাসী-হত্যায় পেয়েছিল ‘অমরত্ব’

পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাচীর কী জিজ্ঞেস করলে এক কথাতেই উত্তর মিলবে সকলের থেকেই। দ্য গ্রেট ওয়াল অফ চায়না। কিন্তু দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীর? এই প্রশ্নের সামনে ধন্ধে পড়ে যাওয়ার কথা অনেকেরই। তবে এমন আশ্চর্যের স্থাপত্য লুকিয়ে রয়েছে ভারতেই। রাজস্থানে। আরবল্লী পর্বতমালার উপরে অবস্থিত ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম দুর্গ কুম্ভলগড়কে ঘিরে রেখেছে এই প্রাচীর। চিনের প্রাচীরের তুলনায় নগণ্য হলেও ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই প্রাচীরই বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম মানবসৃষ্ট প্রাচীর।

দুর্গের নামের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ইতিহাস এবং সৃষ্টিকর্তার নাম। মেওয়ারের শাসক রাণা কুম্ভ পঞ্চাদশ শতকে তৈরি করেন এই দুর্গ। উল্লেখ্য, এই রাজবংশের তৈরি মোট ৮৪টি দুর্গের মধ্যে ৩২টিই তৈরি করেছিলেন রাণা কুম্ভ। তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ এই দুর্গটি। 

নিরাপত্তার দিক নিশ্চিত করতে যেকোনো দুর্গেরই নির্মাণ করা হয় পাহাড়ের ওপরে, নয়তো জঙ্গলের মধ্যে। কুম্ভলগড় দুর্গে রয়েছে দুটি সুবিধাই। তবে তার পরেও বহিরাক্রমণ প্রতিহত করতে ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরটি তৈরি করেছিলেন রাণা কুম্ভ। স্বল্প বিরতিতে যেখানে রয়েছে সেনাদের জন্য বিশ্রামের জায়গা, ওয়াচ টাওয়ার। প্রাচীরের প্রস্থ গড়ে ১৫ ফুট। পাশাপাশি ৮টি ঘোড়া চলতে পারত এই প্রাচীরের ওপর দিয়ে। যা সত্যিই বিস্ময়। এমনকি চিনের প্রাচীরকেও টেক্কা দেওয়ার মতোই।

রাণা কুম্ভের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল রানথাম্বোর থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত। তবে পশ্চিমের মেওয়ার প্রদেশ থেকে সেসময় আক্রমণ লেগেই থাকত হামেশাই। প্রাচীরের নির্মাণ করে মেওয়ার এবং মারওয়ার প্রদেশকে আলাদা করেন রাণা কুম্ভ। প্রাচীর পেরিয়ে দুর্গে প্রবেশ করতে হলে অতিক্রম করতে হবে সাতটি তোরণ। যা স্থানীয় ভাষায় ‘পোল’ নামেই পরিচিত। 

সাতটি তোরণ ও পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীর পেরিয়ে আক্রমণ যে প্রায় অসম্ভব ছিল, তা না বলে দিলেও চলে। ঠিক এই কারণে কুম্ভলগড় দুর্গ পরিচিত ‘অজেয়গড় দুর্গ’ নামেও। গুজরাট শাসক আহমদ শাহ ১৪৫৭ সালে আক্রমণ করে ব্যর্থ হন। ১৪৫৮ এবং ১৪৬৭ সালের মধ্যে বেশ কয়েকবার মাহমুদের আক্রমণকেও প্রতিহত করে ‘গ্রেট ওয়াল অফ ইন্ডিয়া’।

 

আরও পড়ুন
ভূতচতুর্দশীতে আজও তৈরি হয় পেত্নীর মূর্তি; ঐতিহ্যের আড়ালে প্রেতচর্চার ইতিহাস?

ইতিহাস বলে, কেবলমাত্র একবারই এই দুর্গ জয় করা সম্ভব হয়েছিল। তবে কোনো একজন রাজার আক্রমণ ছিল না তা। ছিল তৎকালীন ভারতের প্রতাপশালী ৪ সম্রাটের যৌথ অভিযান। সময়টা ছিল ১৫৭৬ সাল। গুজরাটের সুলতান, আমেরের মান সিং, মেওয়ার শাসক উদয় সিং এবং স্বয়ং মোঘল সম্রাট আকবরের সম্মিলিত বাহিনীর কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল নিশ্ছিদ্র এই দুর্গপ্রাচীর। তবে মহারাণা প্রতাপ ১৫৮৫ সালে পুনরায় দখল করেন কুম্ভলগড় দুর্গ। আকবরের রাজত্বাধীন সময়ে সৈন্যদের তৃষ্ণা মেটাতে প্রাচীরের গায়েই তৈরি হয়েছিল বিশালাকার জলের ট্যাঙ্ক। 

কুম্ভলগড় দুর্গের এই প্রাঙ্গনে রয়েছে মোট ৩৬০টি মন্দির। যার মধ্যে ৩০০টি জৈন মন্দির। বাকিগুলি হিন্দু মন্দির। জৈনধর্মে দীক্ষিত না হলেও এই ধর্মের প্রতি রাণা কুম্ভের বিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করে মন্দিরের উপস্থিতি। 

তবে সে সময় রাতের বেলায় স্বর্গীয় রূপ নিত কুম্ভলগড়ের এই প্রাচীর। প্রতিদিনের জন্য রাণা কুম্ভ বন্দোবস্ত করেছিলেন ১০০ কেজি তুলো এবং ৫০ কেজি ঘিয়ের। তা দিয়েই জ্বালানো হত বিশাল বিশাল মশাল। প্রাচীরের গায়ে জ্বলতে থাকা সেসব অগ্নিশিখা আলোকিত করে রাখত গোটা দুর্গকে। আলো ছড়িয়ে পড়ত কয়েক মাইল দূর অবধি। রাতের অন্ধকারেও যাতে কৃষকদের কাজে কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্যই এই ব্যবস্থা। 

আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গপথে যাওয়া যেত রাজবাড়ি! শোভাবাজারের লাল মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে অদ্ভুত ইতিহাস

আজও নিয়ম করে বছরের তিনদিন ধরে চলে উৎসব। রাজস্থান পর্যটন বিভাগের তত্ত্বাবধানে। আর আলোয় আলোয় সেজে ওঠে গোটা দুর্গ। ফিরে আসে পঞ্চাদশ শতকের সেই রাজকীয় সময়ই। ২০১৩ সালে ইউনেস্কো ‘হেরিটেজ সাইট’ হিসাবে চিহ্নিত করে এই দুর্গকে। পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাচীর হিসাবেও স্বীকৃতি মেলে কুম্ভলগড়ের।

তবে যে প্রাচীর দীর্ঘদিন ধরেই নিরাপত্তা দিয়েছে মেওয়ারের রাজপরিবারকে, যে প্রাচীর ঐতিহ্য বহন করেছে চলেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, সেই প্রাচীরের নির্মাণই একসময় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাণা কুম্ভের কাছে। প্রথম সাত কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীর তৈরির পরই বার বার ভেঙে পড়ছিল পাথরের গাঁথনি। সে সময় এক সাধু তাঁকে জানান কোনো ব্যক্তির আত্মত্যাগের মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব এই প্রাচীরের সম্পূর্ণ নির্মাণ। কিন্তু কে করবে সেই আত্মত্যাগ? 

সমস্যা সমাধানে নিজেই নিজেকে বলি দিতে এগিয়ে আসেন তিনি। জানান, দুর্গ থেকে হাঁটা শুরু করবেন তিনি। যেখানে গিয়ে দ্বিতীয়বারের জন্য থামবেন তিনি, সেখানেই যেন হত্যা করা হয় তাঁকে। পরবর্তীতে সেই দেবীর মন্দির তৈরি করা হয় যেন। একমাত্র এই শর্ত পূর্ণ হলে তবেই তৈরি করা সম্ভব হবে ‘অজেয়’ প্রাচীর। হয়েওছিল তেমনটা। ৩৬ কিলোমিটার হেঁটেছিলেন সেই সন্ত। তারপর আত্মবলিদান। 

আরও পড়ুন
বিষ্ণুপুরে মাটি খুঁড়তে গিয়ে উদ্ধার প্রাচীন সৌধ, লুকিয়ে কোনো অজানা ইতিহাস?

সৃষ্টির পাঁচশো বছর পেরিয়ে এসে আজও অক্ষত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে রাণা কুম্ভের তৈরি ভারতের দীর্ঘতম স্থাপত্য। জড়িয়ে রেখেছে ইতিহাসের গরিমা আর অসংখ্য অবিশ্বাস্য ঘটনাকে। একদিকে মরুভূমি অন্যদিকে ঘন অভয়ারণ্যের মধ্যে এই প্রাচীর আজও যেন এক অতন্দ্র প্রহরী...

Powered by Froala Editor

More From Author See More