ভারত তখন নিজেই ব্রিটিশ রাজশক্তির কাছে পদানত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সামরিক সাহায্যের বিনিময়ে যদিও ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার কথা জানিয়েছিল ইংরেজরা; কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি যে বাস্তবে রাখা হবে না, তা ততদিনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। ঠিক এই সময় খোদ আফগানিস্তানের বুকে রাজত্ব শুরু করেছেন এক ভারতীয়। হ্যাঁ, ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোই যখন ধুঁকছে, তখন হিন্দুকুশ পর্বতের অপর পারে ছড়িয়ে পড়েছে ভারতীয় শাসন। অবশ্য সেটা উপনিবেশ তৈরির জন্য নয়। বরং আফগান সেনাদের সাহায্য নিয়েই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ সিং।
১৮৮৬ সালে উত্তরপ্রদেশের হাথরাস জেলার জাঠ রাজপরিবারে জন্ম মহেন্দ্র প্রতাপের। যদিও নামেই রাজপরিবার। কার্যত ব্রিটিশ শাসকের কর্মচারীর পরিবার বলাই ভালো। তবে মহেন্দ্র প্রতাপের মন ছিল ছোটো থেকেই স্বাধীনচেতা। বিশেষ করে মহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল স্কুলে পড়ার সময় আরও জোরদার হয় তাঁর চিন্তাভাবনা। এই সময়েই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে শুরু হয় স্বদেশি আন্দোলন। পরিবারের হাজার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মহেন্দ্র প্রতাপ কলকাতায় এলেন। জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে দাদাভাই নৌরজি, বাল গঙ্গাধর তিলকের বক্তব্য গভীরভাবে প্রভাবিত করল তাঁকে।
উত্তরপ্রদেশে ফিরে মহেন্দ্র প্রতাপ শুরু করলেন স্বদেশি আন্দোলন। তাঁর উদ্যোগেই সেখানে বিদেশি পণ্য বর্জনের কাজ শুরু হল। পরিবারের সবাই তখন মহেন্দ্র প্রতাপের বিরুদ্ধে। শেষে হাথরাস থেকে বাস তুলে দিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ। বৃন্দাবনে তৈরি করলেন নিজের প্রাসাদ। এর মধ্যেই খবর পেলেন দক্ষিণ আফ্রিকায় এক সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে তুলেছেন মোহনদাস গান্ধী। মহেন্দ্র প্রতাপ গান্ধীর কাজের কথা শুনে ঠিক করলেন তিনিও দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন। যাওয়ার আগে নিজের প্রাসাদে তৈরি করে গেলেন একটি টেকনিক্যাল কলেজ। প্রেম মহাবিদ্যালয়।
তবে শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকা হল না তাঁর। গান্ধীর পরামর্শ মেনে সারা ইউরোপ ঘুরে বেড়ালেন মহেন্দ্র প্রতাপ। উদ্দেশ্য একটাই, সমস্ত বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মৈত্রীচুক্তি তৈরি করে ভারতের স্বাধীনতার আন্দোলনকে জোরদার করা। জার্মানিতে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেলেন তিনি। দ্বিতীয় কাইজার উইলিয়মের সঙ্গে চলল নানা পরিকল্পনা। এখানেই নানারকম সামরিক কৌশল শিখলেন মহেন্দ্র প্রতাপ। পোল্যান্ড সীমান্তে দীর্ঘদিন থেকে নিজে প্রশিক্ষণ নিলেন। তারপর জার্মান সেনাবাহিনীর সঙ্গে পরামর্শ করে কাবুল জয় করলেন। সেটা ১৯১৫ সাল। কাবুলে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি তৈরি হলে ভারতে ব্রিটির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা অনেক সহজ হবে।
আরও পড়ুন
মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে সমকামীদের পাশে আফগান-আমেরিকান ঔপন্যাসিক
যদিও ইতিমধ্যে মহেন্দ্র প্রতাপের যুদ্ধের পরিকল্পনায় অসম্মতি জানিয়েছেন গান্ধী। কিন্তু তিনি নিজে ফিরে আসতে রাজি নন। একটু একটু করে প্রস্তুতি এগোচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেই ঘটে গেল অঘটন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নে এসে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে পড়ল জার্মান বাহিনী। ওদিকে মহেন্দ্র প্রতাপের পরিকল্পনার কথা জেনে গিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। তাঁর মাথার দাম ধার্য করা হয়েছে। তার মধ্যেও বছর দুয়েক কাবুলে রাজত্ব টিকিয়ে রাখলেন মহেন্দ্র প্রতাপ। হঠাৎই একটা চিঠি এল রাশিয়া থেকে।
আরও পড়ুন
ভারতীয়দের রূপচর্চার সঙ্গেও জড়িয়ে আফগানিস্তান, ফিরছে ‘আফগান স্নো’-র স্মৃতি
চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন খোদ লেনিন। ১৯১৮ সাল। রাশিয়ায় তখন সদ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। লেনিন নিজে চান ভারতকে স্বাধীনতার যুদ্ধে সাহায্য করতে। কিন্তু ব্রিটিশ গুপ্তচরের দৃষ্টি এড়িয়ে রাশিয়া পৌঁছানো সম্ভব হল না। তার বদলে জাপানে আশ্রয় নিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ। এখানেই তিনি তৈরি করেছিলেন ‘ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন সেন্টার টু ফ্রি ইন্ডিয়া’। ১৯৪০ সালে জাপানে একটি ভারতীয় সচিবালয়ও তৈরি করেছিলেন তিনি। পরে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গে যা মিলেমিশে যায়।
আরও পড়ুন
মারাঠাদের দমন করতে বিশাল আফগান সৈন্য, ভয়ংকর সেই যুদ্ধের পরিণতি কী?
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এমন একটা বর্ণময় চরিত্র যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছেন। এমনকি একবার মন্ত্রীসভার সদস্য হওয়া ছাড়া স্বাধীন ভারতে তেমন কোনো স্বীকৃতি পাননি মহেন্দ্র প্রতাপ। ১৯৭৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর একটি বিশেষ ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছিল। এই পর্যন্তই। এর থেকে বেশি মনে রাখেনি তাঁর দেশের মানুষ। এমনকি ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগসূত্রের কথাটাও আড়ালেই থেকে গিয়েছে।
Powered by Froala Editor