বিবদমান দুই দেশ ও এক কিশোরের 'বেসবল'-প্রীতি

দুই প্রতিবেশী দেশ কিউবা এবং আমেরিকা। অথচ তাদের রাষ্ট্রকাঠামোয় বিরাট ব্যবধান। কমিউনিস্ট কিউবার সঙ্গে আমেরিকার বিরোধ প্রথম থেকেই। এই বিরোধের মাঝে এক অন্য ভালোবাসার গল্প বুনেছিল মাত্র ১৩ বছরের এক যুবক। সে জানে না পুঁজিবাদ ভালো না সমাজতন্ত্র। শুধু জানে, কিউবাতেও তার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে রয়েছে। তারাও তার মতোই বেসবল খেলতে ভালোবাসে। তবে কিউবা আমেরিকার মতো ধনী দেশ নয়। সেখানে প্রায় কারোরই বেসবলের (Baseball) দামি দামি সরঞ্জাম কেনার সামর্থ্য নেই। আর জেনেছিল তার বংশের এক টুকরো ইতিহাসের কথা। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কিউবা (Cuba) নামের একটি দেশ।

১৩ বছর বয়সে বার মিৎজভা উৎসবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল মাইকা। সমস্ত ইহুদি পরিবারেই এই উৎসব পালন করা হয়। একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর সন্তানকে পরিবারের রীতিনীতি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে পরিবারের ইতিহাসও জানতে হয় তাকে। এই সময়েই মাইকা জানতে পারে তার ঠাকুর্দা হার্বের কাহিনি। জার্মানির ইহুদি পরিবারের সন্তান হার্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার বাবা-মাকে ধরে নিয়ে যায় নাৎসি বাহিনী। পরে অসউইৎজ ক্যাম্পে তাঁদের মেরেও ফেলা হয়। তবে হার্ব সবার চোখ এড়িয়ে চেপে বসেছিলেন একটি জাহাজে। নিউ ইয়র্ক বন্দরের দিকে যাচ্ছিল সেই জাহাজ। হার্ব জানতেন, আমেরিকায় তখন সমস্ত ইহুদিদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।

তবে আমেরিকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেন না হার্ব। কারণ ততদিনে আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরে বোমা ফেলেছে জাপান। আর তাই আমেরিকাও সরাসরি যুদ্ধের মেজাজে চলে এসেছে। এখন আর কোনো বিদেশীকে জায়গা দেওয়া হবে না। তখন জার্মানি থেকে আসা অনেক জাহাজকেই ফিরিয়ে দিয়েছিল আমেরিকা। নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে একবার পালিয়ে গিয়েও আবার ধরা দিতে হয়েছিল অনেককে। কিন্তু হার্বের সেই অবস্থা হয়নি। কারণ হাভানা শহরের কাছে জাহাজ থামতেই তিনি নেমে পড়েছিলেন। আর তারপর বেশ কয়েক বছর কাটিয়েছিলেন কিউবাতেই। সেখানে সবাই তাঁকে আপন করে নিয়েছিলেন। অনাথ ছেলেটিকে স্নেহ দিয়ে ভরিয়ে তুলেছিলেন প্রত্যেকে। অবশ্য তারপর কিউবায় বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবে কিউবা ছেড়ে আমেরিকায় চলে আসেন হার্ব। কিন্তু বুকের মধ্যে এক টুকরো কিউবাকে রেখে দিয়েছিলেন সবসময়।

৭০ বছর পর নাতির কাছে সেইসব গল্প করছিলেন হার্ব। তবে মাইককে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল, কিউবার ছেলেমেয়েদের বেসবল খেলার গল্পগুলো। সাধারণ লাঠি আর পাথর দিয়েই বেসবল খেলত তারা। এমনকি দাদু তাকে জানায়, এখনও কিউবার ছেলেমেয়েরা এভাবেই বেসবল খেলে। কয়েকজন হয়তো জাতীয় দলে জায়গা পায়। কেবল তাদের জন্য দামি দামি সরঞ্জাম থাকে।

আরও পড়ুন
বন্ধ ইন্টারনেট ব্যবস্থা, প্রতিবাদ দমনে সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ কিউবা সরকারের

বার মিৎজভা উৎসবের সময়েই একটি কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে হয় প্রত্যেক সন্তানকে। এমন কোনো কাজের প্রতিশ্রুতি, যাতে অনেক মানুষের উপকার হবে। মাইকা সেদিন জানায়, সে কিউবার ছেলেমেয়েদের জন্য বেসবলের সরঞ্জাম পৌঁছে দিতে চায়। কাজটা সহজ নয়। একা আর কতটুকু অর্থই বা যোগাড় করা যায়? কিন্তু মাইকা হাল ছাড়তে রাজি নয়। সে তার স্কুল থেকে শুরু করে নানা সেমিনারে ঠাকুর্দার কাহিনির কথা বলতে থাকে। মানুষের কাছে অর্থসাহায্য চায়। আমেরিকার অনেক মানুষই অবশ্য কিউবার কথা পছন্দ করেন না। তাই বারবার বাধাও পেতে হয় তাকে। কিন্তু অনেকেই আবার এগিয়েও আসে।

আরও পড়ুন
বাদ পড়েছে WHO-এর প্রকল্প থেকে, অবশেষে নিজের দেশেই ভ্যাকসিন তৈরির পথে কিউবা

অবশেষে ২০১৪ সালে বাবা-মা এবং ঠাকুর্দাকে সঙ্গে নিয়ে কিউবায় এসে নামে মাইকা। সঙ্গে ২ হাজারটি বেসবল সরঞ্জামের সেট। মাইকার এই কাহিনিকে নিয়ে সেই বছরই মুক্তি পায় হলিউডের একটি সিনেমাও। যার নাম ‘হাভানা কার্ভবল’। উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে এমন এক ভালোবাসার কাহিনি অবাক করেছিল দর্শকদের। কিন্তু এই কাহিনি যে নিছক মনগড়া নয়, বরং তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাস্তবের এক কিশোরের গল্প, সেই খবর রাখেন না অনেকেই।

আরও পড়ুন
কিউবা-রাজনীতিতে ‘ঐতিহাসিক প্রজন্মে’র ইতি, পদত্যাগ করলেন রাউল কাস্ত্রো

Powered by Froala Editor