কুকুরের প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে খোয়ায় দু-হাত, মানুষ মনে রাখেনি যে-কিশোরের বীরত্ব

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১১টা। আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে ট্রেন। মানুষের ভিড়ে ছেয়ে আছে স্টেশন। সেই ভিড় ঠেলেই কোনোক্রমে এগিয়ে চলেছে বছর সাতেকের এক কিশোর। কয়েকদিনের ছুটি কাটাতে যাবে সে। সঙ্গে বাবা-মা আর পরিবারের ছোট্ট পোষ্য সারমেয়। এমন সময়ই ঘটে গেল এক বিপত্তি। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রেন এবং প্ল্যাটফর্মের ফাঁকে গলে গিয়ে রেলট্র্যাকে পড়ে গেল মাস চারেকের কুকুর ছানাটি। এদিকে সিগন্যাল হলুদ হয়ে উঠেছে ততক্ষণে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ঠ না করে, ছোট্ট বন্ধুকে উদ্ধার করতে রেললাইনে নেমে পড়েছিল বছর সাতেকের কিশোর। 

ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪ সাল। এক মর্মান্তিক, হৃদয়স্পর্শী দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্টাকি অ্যান্ড ইন্ডিয়ানা রেলওয়ে স্টেশন। ছোট্ট একটি কুকুরছানার প্রাণ বাঁচানোর জন্য, সেদিন নিজের দুই হাত হারাতে হয়েছিল ৭ বছর বয়সি জেমস ওয়েলচকে (James Welch)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছিল তার সাহসিকতা এবং বীরত্বের কাহিনি।

হ্যাঁ, জেমস রেললাইনে নেমে পড়ার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অপ্রত্যাশিতভাবে চলতে শুরু করে ট্রেনটি। তখনও তার হাত ঢুকে রয়েছে রেলওয়ে ট্র্যাকে। হাতে ধরা কুকুরছানা। বিপদের আঁচ পেয়ে প্ল্যাটফর্মের মানুষজন, জেমসের বাবা-মা চিৎকার শুরু করলে, চালক ট্রেন থামান ঠিকই। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অনেকটাই। তৎকালীন সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১০০ ফুট পথ রেলট্র্যাকে ঘষতে ঘষতে যেতে হয়েছিল জেমস এবং তার পোষ্য স্মোকিকে। যার ফল স্বরূপ, কবজির একটু উপর থেকে কাটা পড়ে জেমসের দুই হাতই। অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে প্রাণ বাঁচলেও, কিছুদিনের মধ্যে মারা যায় কুকুরছানাটিও। 

অবশ্য জেমসের এই বীরত্বের কাহিনি সে-যুগে প্রায় সমস্ত পত্রপত্রিকায়, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও, তা বেশিদিন মনে রাখেনি মানুষ। এমনকি শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জেরে প্রায় একঘরে হতে হয়েছিল তাকে। দু-হাত না থাকলেও, সাঁতার কাটা, বাইক চালানো কিংবা বইয়ের পাতা উল্টানোর মতো কাজের দক্ষতা রপ্ত করেছিল জেমস। পড়াশোনাতেও যে খারাপ ছিল, তেমনটা নয় একেবারেই। কিন্তু ওই যে, দুটি হাতই নেই তার। আর সেই কারণেই বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আবেদন করেও নতমুখে শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে হয়েছিল তাকে। ক্রমশ তাকে গ্রাস করা শুরু করে অবসাদ। সেইসঙ্গে থাবা বসায় অর্থাভাবও। 

আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই তীব্র মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে জেমস। পা দেয় নিষিদ্ধ ড্রাগ, অ্যালকোহলের দুনিয়ায়। শেষ পর্যন্ত এই মাদকাসক্তিই প্রাণ কেড়ে নেয় তার। ১৯৯৩ সাল। জেমসেরই এক বন্ধু প্রাণহীন অবস্থায় জেমসের দেহ উদ্ধার করে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে। জেমসের মৃত্যুর পরও আরও একবার সরগরম হয়ে উঠেছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম। তাকে উৎসর্গ করে লেখা হয়েছিল বিভিন্ন প্রতিবেদন, জানানো হয়েছিল সম্মাননা। অথচ, জীবদ্দশায় সামান্যতম সাহায্যের জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়নি কেউ-ই। সাধারণ মানুষ ভুলে গিয়েছিল তাঁর বীরত্বের কাহিনি। সেদিক থেকে দেখতে গেলে, তার মৃত্যু যেন স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না কোনোদিক থেকেই। বরং, খোদ সমাজই ছিল তার হত্যাকারী!

Powered by Froala Editor