১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল। জালিয়ানওয়ালাবাগের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেন জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ার। সারা দেশজুড়ে জমতে থাকা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে এক ধাক্কায় বাড়িয়ে দিল সেই ঘটনা। এর কিছুকাল পরের কথা। লন্ডনের আদালতে মামলা করে বসলেন খোদ ডায়ার সাহেব। সদ্য প্রকাশিত একটি বইতে তাঁকে অপমান করা হয়েছে। সরাসরি গণহত্যাকারী বলে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে। আর এতেই মানহানির মামলা করেছেন তিনি। মামলা করেছেন এক ভারতীয়ের বিরুদ্ধে। তাঁর নাম স্যার চিত্তুর শঙ্করন নায়ার।
তাঁর নাম হয়তো অনেকের কাছেই অজানা। অথচ দক্ষিণ ভারতের এই মানুষটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ডায়ারের সঙ্গে মামলাটি তো উল্লেখযোগ্য বটেই। এছাড়া তিনি ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম পর্বের একজন স্থপতি। কংগ্রেসের সভাপতিত্বও করেছেন। আবার প্রয়োজনে সমালোচনাও করেছেন কঠোরভাবে। ১৮৫৭ সালে মালাবার উপকূলের মানকড় গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে জন্ম চিত্তুর শঙ্করনের। তিন প্রজন্ম ধরে তাঁর পরিবার ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কর্মরত। ফলে শিক্ষার সুযোগ ছিল শুরু থেকেই। সেইসঙ্গেই গড়ে উঠেছিল যুক্তিবাদী মানসিকতা।
মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনার পর তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্যার হোরাশিও সেফার্ডের জুনিয়র হিসাবে। তখন ১৮৮০ সাল। একটু একটু করে নিজের যোগ্যতায় জায়গা করে নিচ্ছিলেন প্রশাসনিক মহলে। আর সেইসঙ্গে দেশজুড়ে প্রথম শোনা যাচ্ছে ভারতীয়দের স্বায়ত্বশাসনের দাবি। না, পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তখনও ওঠেনি। জাতীয় কংগ্রেসের সেই জন্মলগ্ন থেকেই জড়িয়ে পড়েছিলেন চিত্তুর শঙ্করন। ১৮৯৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতিত্বও করেন তিনি। কিন্তু দলের মধ্যে অন্তর্কলহের জেরে শেষ পর্যন্ত সরে এসেছিলেন তিনি।
শোনা যায় মাদ্রাজ হাইকোর্টের ভারতীয় আইনজীবীরা একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, ব্রিটিশ আইনজীবীদের জুনিয়র হিসাবে কাজ করবে না কেউ। এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন চিত্তুর। মানুষকে তাঁর জাতিপরিচয়ের উর্ধ্বে উঠেই চিনতে শিখেছিলেন তিনি। অবশ্য ভারতীয়দের প্রশাসনিক অধিকারের দাবি থেকে সরে আসেননি কখনও। তাঁর লাগাতার প্রতিবাদের জেরেই মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের খসড়া প্রায় আমূল বদলে যায়। শেষ পর্যন্ত ১৯১৯ সালে এই আইনের ভিত্তিতেই শুরু হয় দ্বৈত শাসনব্যবস্থা। ব্রিটিশ শাসনের মধ্যেই আংশিক গণতন্ত্রের স্বাদ পান ভারতীয়রা। কিন্তু ইতিমধ্যে ঘটে গিয়েছে জালিয়ানওয়ালাবাগের কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড।
আরও পড়ুন
নিজাম পরিবারের কন্যার প্রেমে ইংরেজ সাহেব, বদলে নিলেন নাম–পোশাকও
১৯২২ সালে একটি বই লেখেন চিত্তুর। বইয়ের নাম ‘গান্ধী অ্যান্ড অ্যানার্কি’। মূলত মহাত্মা গান্ধীর সমালোচনা করেই লেখা হয়েছিল বইটি। পাতায় পাতায় ব্যাখ্যা করেছিলেন তাঁর অহিংস অসহযোগ আন্দোলন আসলে হিংসাত্মক প্রবণতাকেই বাড়িয়ে তুলছে। আর এর মধ্যেই তুলে এনেছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনাটিও। খুব বিস্তৃত অধ্যায় নয়। কিন্তু তাঁর এই খোলাখুলি সমালোচনায় রুষ্ট হয়েছিলেন জেনারেল ডায়ার। চিত্তুর তো সরকারের খাতায় একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী নন। তিনি রীতিমতো রাজকর্মচারী। এমনকি ১৯১২ সালে তাঁকে নাইট উপাধিতে ভূষিত করেছেন খোদ মহারানি।
আরও পড়ুন
শহিদ হওয়ার আগেই ইংরেজ জেলাশাসককে হত্যা, রক্তাক্ত মেদিনীপুরের ফুটবল মাঠ
শেষ পর্যন্ত মামলা শুরু হল লন্ডনের আদালতে। প্রধান বিচারক হেনরি ম্যাক-কার্ডি। এবং তাঁর সঙ্গে ১২ জন জুরি। ৫ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে চলল মামলার শুনানি। সেই সময়ে এটিই ব্রিটিশ আদালতে দীর্ঘতম নাগরিক মামলা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিচারের নামে ঘটে গেল প্রহসন। ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের অনেকেই ডায়ারের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু প্রশাসনিক কর্তারা অধিকাংশই মনে করেছিলেন, ডায়ার সঠিক কাজই করেছেন। দুর্বৃত্ত ভারতীয়দের এভাবেই শক্ত হাতে দমন করা উচিৎ। চিত্তুর আশা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত আইনের মর্যাদা রেখেই রায় দেবেন বিচারক। ব্যক্তিগত বা জাতিগত বিদ্বেষ সেখানে বড়ো হয়ে উঠবে না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হতাশ হলেন তিনি। ম্যাক-কার্ডি তো বটেই, ১২ জন জুরির মধ্যে ১১ জনই রায় দিলেন চিত্তুরের বিপক্ষে। বিচারে তাঁর কাছে ৫০০ ইউরো জরিমানা দাবি করা হল।
আরও পড়ুন
তখনও পরাধীন ভারত; ইংরেজদের হটিয়ে বাংলাতেই জন্ম নিয়েছিল দুটি ‘স্বাধীন’ সরকার
ডায়ার অবশ্য বলেছিলেন চিত্তুর ক্ষমা চাইলেই তাঁর জরিমানা মুকুব করা হবে। কিন্তু ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন চিত্তুর। আর এর পর থেকেই ব্রিটিশ সরকারের উপর থেকে তাঁর যাবতীয় শ্রদ্ধাও চলে যায়। এতদিন তিনি মনে করতেন ব্রিটিশ আধিপত্যের মধ্যে থেকেও ভারতীয়রা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে। সেই মত বদলে যায় অচিরেই। যদিও বয়সের ভারে আর নতুন করে আন্দোলনে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৩৪ সালে দেশজুড়ে স্বাধীনতার অভ্যুত্থানের সাক্ষী থেকেই বিদায় নিলেন স্যার চিত্তুর শঙ্করন নায়ার।
২০১৯ সালে এই প্রায় ভুলে যাওয়া ব্যক্তিত্বকে নিয়েই একটি বই লেখেন চিত্তুরের প্রপৌত্র রঘু পলট ও তাঁর স্ত্রী পুষ্পা পলট। আর সেই জীবনীকেই এবার সিনেমার পর্দায় তুলে আনার উদ্যোগ নিলেন বলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক করণ জোহর। খুব তাড়াতাড়ি সেই সিনেমা মুক্তি পাবে বলেও জানিয়েছেন পরিচালক। এখন অপেক্ষা শুধু বড়ো পর্দায় এমন একজন স্পষ্টবাদী মানুষের জীবনের সাক্ষী থাকার।
Powered by Froala Editor