মৃত একটা গাছের ডালকে দেখে কি কখনও মনে হয়েছে, সেটা আসলে একটা হরিণ? অথবা অন্য কোনো জন্তু! অনেকেই হয়তো মন দিয়ে সেভাবে খেয়াল করি না। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের এভাবেই দেখতে শিখিয়েছিলেন। এমনকি বাকি অংশ কেটে-ছেঁটে যখন তাকে হাজির করা হয়, তখন আর কারোরই বুঝতে বাকি থাকে না। এমন ধরনের শিল্পের একটা নামও দিয়েছিলেন তিনি। ‘কাটুম-কুটুম’।
বাঁকুড়া জেলার অখ্যাত শিল্পী পবন লোহার তাঁর জীবনের ৩৬ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন এই কাটুম-কুটুমের সাধনাতেই। এখনও নীরবে সেই কাজ করে চলেছেন। তবে শিল্পের অন্যান্য ধারা ছেড়ে কাটুম-কুটুমকেই কেন বেছে নিলেন তিনি? কীভাবে এত বছর ধরে সাধনা করে চলেছেন তিনি? এইসব তথ্য জানতেই আমরা যোগাযোগ করেছিলাম পবন লোহারের সঙ্গে।
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর এলাকার চূয়া মসিনা গ্রামের দরিদ্র উপজাতি সম্প্রদায়ে জন্ম পবন লোহারের। বাড়িতে পড়াশোনার পরিবেশ ছিল না কোনোদিন। কিন্তু পবন লোহার চেয়েছিলেন নতুন সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বড়ো হতে। আর সেইসঙ্গে ছিল ছবি আঁকার অদ্ভুত টান। মনে মনে শিল্পী হতেই চেয়েছিলেন পবন। এর মধ্যেই ১৯৭৮ সালে তিনি মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। কিন্তু এরপর কী করবেন? তাঁর গ্রামের একজন তখন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় অধ্যাপনা করেন। পবনের ছবি আঁকার ইচ্ছা দেখে তিনি যোগাযোগ করতে বলেছিলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর তিনি চলে গেলেন বোলপুর।
“বিশ্বভারতীতে গিয়ে সমস্ত মিউজিয়াম ঘুরে ঘুরে দেখেছিলাম। তখনই প্রথম পরিচয় হল অবনীন্দ্রনাথের কাটুম-কুটুমের সঙ্গে। দেখে বেশ আশ্চর্য লেগেছিল। সেইসঙ্গে আকর্ষণও বোধ করেছিলাম।” এরপর বিশ্বভারতীতে পড়াশোনার সুযোগ পেলেন তিনি ঠিকই, কিন্তু তার যাবতীয় খরচ বহন করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। তাই শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনার ইচ্ছা তাঁকে ছাড়তে হল।
গ্রামে ফিরে এসে আবারও ছবি আঁকার চেষ্টা করেছিলেন পবন লোহার। কিন্তু কোনোরকমের প্রশিক্ষণ ছাড়া ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি তিনি করতে পারবেন না বলেই মনে করেছিলেন। এমন সময় ১৯৮৪ সালে ছাঁদার গ্রামে উৎপল চক্রবর্তীর শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘অভিব্যক্তি’ আয়োজিত একটি প্রদর্শনীতে আবারও কাটুম-কুটুম দেখলেন তিনি। মনে পরে গেল সেই বোলপুরের মিউজিয়ামে দেখা অবন ঠাকুরের সৃষ্টিগুলির কথা। সেই বছরই স্থানীয় একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি পেলেন পবন লোহার। আর তার পাশাপাশি শুরু করলেন কাটুম-কুটুম তৈরি।
সেই থেকে এখনও পর্যন্ত একই কাজ করে চলেছেন তিনি। “এখন সংগ্রহ এত বেশি যে বাড়িতে আর জায়গা হয় না। কিন্তু কাউকে আমি এই শিল্প বিক্রি করিনি। উপার্জন তো ঠিকই চলে যায়। কিন্তু আমি চাই আমার কাজ থেকে উৎসাহী ছেলেমেয়েরা শিখুক।” কাটুম-কুটুম শেখানোর জন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির কথাও ভেবেছিলেন পবন লোহার। বছর পনেরো আগে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ১০০ বছরের লিজে কিছুটা জায়গাও পেয়েছিলেন। কিন্তু স্থানীয় মানুষদের সহযোগিতার অভাবে শেষ পর্যন্ত আর সেটা হয়ে ওঠেনি। একজন তফসিলি উপজাতির মানুষের নেতৃত্বে এত বড়ো একটা কর্মজজ্ঞ মেনে নিতে পারেননি তাঁরা।
তবে আগামী বছরের শুরুতেই পবন লোহারের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে। তারপর আবার নতুন করে কাজ শুরু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তিনি। বলছিলেন, “কোন গাছের ডাল বেছে নেব, কোন গাছের শিকড় – সেসব চিনতে শিখতে হয়। গাছের ডালে অনেক ক্ষেত্রেই তাড়াতাড়ি ঘুণপোকায় আক্রান্ত হয়। তাই আমি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিকড় ব্যবহার করি। আর সেক্ষেত্রেও নজর রাখতে হয়, শিকড় শুকনো এবং শক্ত হলে বেশিদিন টেকে।” মৃত্যুর আগে এইসব বিষয় ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে যেতে চান তিনি। আর সেইসঙ্গে এই প্রায় অনাদৃত শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে চান তিনি।
তাঁর কথায়, “আমি নানা জায়গায় প্রদর্শনীতে ঘুরে দেখেছি, এ জিনিসের চাহিদা আছে। বাজারে নিয়ে আসতে পারলে মানুষ কিনবে। আমি বিক্রি করতে না চাইলেও অনেকে কিনতে চেয়েছেন। এই শিল্পকে ঘিরে যদি কিছু মানুষ উপার্জনের রাস্তা খুঁজে পায়, তাহলে তো খুশি না হওয়ার কিছু নেই।”
না, এই ৩৬ বছরের সাধনার জন্য তেমন কোনো সম্মান বা স্বীকৃতি পাননি তিনি। তাঁর শিল্পকে যেমন অনেকে পছন্দ করেছেন, অনেকেই আবার তাতে তেমন পাত্তাও দেননি। কিন্তু সামান্য গাছের শিকড় থেকে জন্তু-জানোয়ার বা মানুষের প্রতিকৃতি খুঁজে দেখার জন্য যে চোখ থাকার দরকার, সেটা তো একজন প্রকৃত শিল্পীরই থাকে। তবু হয়তো পাশ্চাত্য ঘরনায় এই শিল্প স্বীকৃতি পায়নি বলেই আমাদের দেশেও অনাদৃত। ঠিক যেমন অনাদৃত ঐতিহ্যবাহী পট-শিল্প। কাটুম-কুটুমের অবশ্য দীর্ঘ ইতিহাস নেই। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই এর জন্ম। কিন্তু এর সম্ভাবনা বিস্তর। সেই পথ দিয়ে কতদূর এগিয়ে যেতে পারবেন পবন লোহার, সেটাই দেখার। সমাজের সঙ্গে লড়াই করে এই শিল্পকে কি স্বীকৃতি এনে দিতে পারবেন তিনি?
Powered by Froala Editor