কথায় কথায় আমরা বলি ‘হিরের টুকরো ছেলে’। প্রবাদেই হোক বা বাস্তবে— আমাদের ওপর এই অদ্ভুত সুন্দর বস্তুটির অবদান কিন্তু কম নয়। অন্তত ইতিহাসের দিক থেকে তো নয়ই। কোহিনূর বলুন, বা ‘হীরক রাজার দেশে’— ক্ষণে ক্ষণে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এই হিরে। তবে যদি বলি, এই হিরেই একবার একটি কোম্পানিকে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল? তাও যে সে কোম্পানি নয়, স্বয়ং টাটাদের কোম্পানি! এবং হিরেটিও ছোটোখাটো নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বহু ইতিহাস, বহু ওজন। সেই পৃথিবীখ্যাত ‘জুবিলি ডায়মন্ড’-এর ভেতর থেকেই খানিক আলোকছটা এসে পড়ুক এই কাহিনির ওপর…
সাল ১৯০০। নতুন একটি শতাব্দী; নতুন আশা, নতুন স্বপ্নের ডালি নিয়ে হাজির হল বিশ্বে। সেইসঙ্গে প্যারিসেও শুরু হল একটি বিশেষ প্রদর্শনী। যারাই এলেন, প্রত্যেকে তাকিয়ে থাকলেন একটি বিশেষ বস্তুর দিকে। প্রমাণ সাইজের একটি হিরে, হিসেব করে বললে ২৪৫ ক্যারাটের থেকে একটু বেশি। আলোর সামনে রীতিমতো ঝলকে উঠছে সেই বস্তুটি। এটিই বিখ্যাত ‘জুবিলি ডায়মন্ড’। বস্তুত, প্যারিসের প্রদর্শনীর পরেই এই হিরেটি কিনে নেন স্যার দোরাবজি টাটা। তাঁর প্রিয়তমা পত্নী, লেডি মেহেরবাঈ টাটাকে উপহার দেবেন তিনি। ফ্রান্স থেকে সোজা ভারতের মাটি ছুঁল ‘জুবিলি ডায়মন্ড’…
পরবর্তী গল্পে যাওয়ার আগে একটু অতীতে ফিরে যাওয়া যাক। একটা সময় ছিল, যখন ভারত এবং ব্রাজিল— এই দুটি দেশকে পৃথিবীর হিরের ভাণ্ডার মনে করা হত। অবস্থাটা বদলাল তখন, যখন দক্ষিণ আফ্রিকার বুকে হিরে আবিষ্কৃত হল। এ এক নতুন ইতিহাস। আফ্রিকা মহাদেশটিই তখন সম্পূর্ণ আবিষ্কার করা হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার হিরে আবিষ্কার এক অন্য গোলার্ধ খুলে দিল। আর সেখান থেকেই ১৮৯৫ সালে পাওয়া গেল জুবিলি ডায়মন্ড। পালিশ টালিশ করার পর রূপ ফিরে পেল এই মহামূল্য বস্তুটি। এখনও অবধি পৃথিবীর সবথেকে বড়ো হিরেদের তালিকায় ছয় নম্বরে এটি; বিখ্যাত কোহিনূরের থেকেও দ্বিগুণের বেশি ভারী।
প্রথমে অবশ্য এর নাম ‘জুবিলি’ ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকার হিরে খনির প্রেসিডেন্ট ও প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ফ্রান্সিস ওয়িলিয়াম রেইটসের নাম অনুযায়ী এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘রেইটস ডায়মন্ড’। পর্তুগালের রাজা প্রথম কার্লোস নিজের স্ত্রীকে উপহার দেওয়ার জন্য প্রথম এই হিরেটি কেনেন লন্ডন থেকে। কিন্তু এখানেই বাঁধল একটু গণ্ডগোল। মনে রাখতে হবে, সময়টা উনবিংশ শতকের শেষের দিক। ১৮৯৭ সাল ছিল রানি ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে বসার ৬০ বছর পূর্তির সময়। ঠিক করা হয়েছিল, হিরেটি রানিকেই উপহারস্বরূপ দেওয়া হবে। কিন্তু সেটা চলে গেল পর্তুগালের রাজার কাছে। কিন্তু রানির স্মৃতি রাখার জন্য হিরেটির নাম বদলে দেওয়া হয়। নতুন নাম হয় ‘জুবিলি ডায়মন্ড’।
আরও পড়ুন
জার্মানির সমুদ্র থেকে উদ্ধার হিটলারের এনিগমা কোডিং যন্ত্র
এই জুবিলি ডায়মন্ডই ঘুরে ফিরে হাজির হল কোহিনূরের দেশে। স্যার দোরাবজি টাটা তখন নিজের কাজে ভীষণ ব্যস্ত। টাটার শিল্প সাম্রাজ্য একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে। জামশেদপুর তো আছেই; দোরাবজি ধরলেন মুম্বইকে। বিংশ শতকের গোড়াতেই এক এক করে তৈরি হল তাজ হোটেল, টাটা স্টিল কোম্পানি বা টিসকো, টাটা বিদ্যুৎ ইত্যাদি সংস্থাগুলি। দোরাবজি টাটা তখন গ্রুপের সর্বময় কর্তা; আর তাঁর স্ত্রী লেডি মেহেরবাঈ টাটাও নিজের নারীকল্যাণমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ভারতে এক নতুন সূর্যের হদিশ দিচ্ছে এই পরিবার…
কিন্তু সময় তো সবার সময় যায় না। সময়ের কাঁটা বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদেরও ছাড়ে না। সেই কুড়ুল এসে পড়ল দোরাবজির মাথায়। মোটামুটি ১৯২৪ সাল থেকে ভারতের বাজার ছেয়ে গেল জাপানি লোহায়। তুলনামূলক সস্তা এই লোহা কেনাই সুবিধাজনক মনে করল সবাই। তাতে কোপ পড়ল টাটা স্টিল বা টিসকো’র একচেটিয়া সাম্রাজ্যে। বেশিদিন না হলেও, টাটাদের কোম্পানি তো! তাঁদের এমন অবস্থা অনেকে কল্পনাও করতে পারেননি। রীতিমতো কপর্দকশূন্য হয়ে যান দোরাবজি। মাথার ওপর বিশাল ঋণ; তখনকার দিনে তার পরিমাণ ছিল প্রায় দুই কোটি টাকা! অঙ্কটা যে কত ব্যাপক, সেটা হয়তো আমরা কল্পনাও করতে পারব না। এমন অবস্থা হল, টাটা স্টিল কোম্পানিটিই হয়তো বন্ধ করে দিতে হবে…
আরও পড়ুন
নর্দমা থেকে উদ্ধার ১৭০০ বছরের প্রাচীন গ্রিক দেবতার মূর্তি
দোরাবজি দম্পতির আর্টের দিকে বিশেষ শখ ছিল। যেখানেই যেতেন, সেখান থেকে পুরনো, ঐতিহ্যশালী ও সৌখিন সামগ্রী নিয়ে আসতেন। নিজেদের সংগ্রহে রাখতেন যত্ন করে। সেই সংগ্রহের মধ্যে ছিল জুবিলি ডায়মন্ডও। টাটা স্টিলকে কেন্দ্র করে যখন ব্যবসা প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে, টাটা সাম্রাজ্যের পতনের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ— সেই সময় এই হিরেরই শরণাপন্ন হলেন দোরাবজি টাটা। জুবিলি ডায়মন্ড, এবং আরও কিছু গয়না বন্ধক রাখলেন ইম্পেরিয়াল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায় (বর্তমানে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া)। স্বভাবতই বিশাল অঙ্কের লোনও পেলেন। সেই যাত্রায় টাটা স্টিল বেঁচে গেল। সেদিন যদি জুবিলি ডায়মন্ড না থাকত, তবে আজকে ভারতের অন্যতম প্রধান শিল্পগোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানটিকে দেখতেই পেতাম না আমরা…
যার জন্য হিরেটি কিনেছিলেন, সেই লেডি মেহেরবাঈ টাটাও স্বামীর এই পদক্ষেপে সঙ্গ দিয়েছিলেন। তিরিশের দশকেই পরপর চলে যান দুজনেই; প্রথমে মেহেরবাঈ, পরে দোরাবজি টাটা। দোরাবজির উইল অনুযায়ী, তাঁর ব্যক্তিগত ট্রাস্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয় জুবিলি ডায়মন্ড-সহ সমস্ত গয়না ও শিল্প সামগ্রী, যা এতদিন ধরে সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। পরবর্তীতে এই জুবিলি ডায়মন্ডই বিক্রি করে দেওয়া হয়। যা টাকা আসে, সেখান থেকে তৈরি করা হয় আরেকটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান— টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতাল। আর জুবিলি ডায়মন্ড? আজও মহা সমারোহে, অত্যন্ত যত্নে ও কড়া পাহারায় রয়েছে সে। এতটুকুও ফিকে হয়নি; যত সময় গেছে ইতিহাস আর সময়ের আলো ঠিকরে বেরিয়েছে তার ভেতর থেকে। আর সেখানেই লেগে রয়েছে ভারতের এক অনামি ইতিহাস…
আরও পড়ুন
বিষ্ণুপুরে মাটি খুঁড়তে গিয়ে উদ্ধার প্রাচীন সৌধ, লুকিয়ে কোনো অজানা ইতিহাস?
Powered by Froala Editor