নিজের বাড়িতে বেশ তৈরি হয়ে বসে আছেন সত্যজিৎ রায়। সেটা ছিল পঞ্চাশের দশকের শেষের পর্যায়। ‘পথের পাঁচালি’ পেরিয়ে পরিচালক এসে পৌঁছেছেন ‘জলসাঘর’ পর্যন্ত। দেশে-বিদেশে তাঁর ছবি সমাদৃত। এবার নতুন একটি ছবির কাজ। ঘুরে ফিরে সেই অপুর কাছেই গেলেন সত্যজিৎ। কিশোর অপু এখন তরতাজা যুবক। সে লিখতে চায়, রোম্যান্টিক প্রকৃতির, দারিদ্র মিটছে না; ‘তা সত্তেও সে জীবনবিমুখ হচ্ছে না।’ এমনই যুবক অপুর সংসারযাপন নিয়ে পরবর্তী ছবি করতে চলেছেন সত্যজিৎ।
কিন্তু এখানেই একটু মুশকিল। অপু-কে তো পাওয়া গিয়েছে; কিন্তু অপর্ণা? ‘অপুর সংসার’ গড়তে যে তাঁকেও লাগবে। একটি বছর তেরোর উপযুক্ত মেয়ের সন্ধান করে যাচ্ছেন সত্যজিৎ। কিন্তু কিছুতেই মনের মতো কেউ আসছে না। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছে, কিছুই হয়নি। হঠাৎই একজনের দিকে নজর পড়ল তাঁর। মেয়েটি সেন্ট জন’স ডায়সেশনে পড়ে। স্মার্ট, ঝকঝকে চেহারা; সেইসঙ্গে আছে আভিজাত্য। ঠাকুর পরিবারের সন্তান সে; বাবা গীতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতি। বিদ্যুৎ খেলে গেল সত্যজিৎ রায়ের মাথায়। এই মেয়েটি তো ‘অপর্ণা’ হতে পারবে! ব্যস, এরপরেই তৈরি হল ইতিহাস। ‘অপুর সংসার’-এর দরজা খুলে অভিনয় জগতে প্রবেশ সেই ত্রয়োদশী, শর্মিলা ঠাকুরের…
বাংলা তো বটেই, গোটা ভারতীয় সিনেজগতে ষাট-সত্তর দশক থেকে যারা শাসন করেছেন, সেখানে শর্মিলা ঠাকুর আসবেন না তা কি হয়! জীবনের প্রথম সিনেমাতেই সাক্ষ্য রেখেছেন প্রতিভার; সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পাশে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করে গেছেন। আবার তার পরের বছরই ফিরে এসেছেন ‘দেবী’ হয়ে। ফিরে তাকাতে হয়নি আর; কেরিয়ার গ্রাফ তরতরিয়ে উপরে উঠেছে। সৌমিত্রের পর উত্তমকুমার, তারপর সেখান থেকে সোজা ‘কাশ্মীর কি কলি’— শর্মিলার দাপট ছিল সর্বত্র।
আক্ষরিক অর্থে দাপটই বটে। তাঁর সিনেমার গান যেমন আজও লোকের মুখে মুখে ঘোরে; তেমনই রূপের অনুরাগীও প্রচুর। গালে সেই টোল-পরা হাসি, সতেজ দুটো চোখ আর স্বভাব আভিজাত্য— এর বাইরেও শর্মিলা ছিলেন অনন্যা। সত্তর পেরিয়েও কি অসামান্যা তিনি! শর্মিলা ঠাকুরের কেরিয়ারের দিকে একবার নজর দিলে, সেই সাহসী, স্মার্ট ভঙ্গিটাই নজরে আসবে। মনে পড়বে ১৯৬৭ সালের কথা। শক্তি সামন্তের ‘আ ইভনিং ইন প্যারিস’-এ শাম্মি কাপুরের বিপরীতে রয়েছেন বছর তেইশের শর্মিলা। সেখানেই বিকিনির মতো খোলামেলা পোশাকে হাজির হলেন নায়িকা। আপামর ভারতের দর্শক ঘাবড়ে গেলেন এমন দৃশ্যে। এর আগে পর্দায় এমন পোশাক পরে কোনো নায়িকাই আসেননি, বলা ভালো আসতে সাহস পাননি। সেখানে এই মেয়েটি সমস্ত বেড়া টপকে গেল!
নিজের মতে চলেছেন সর্বক্ষণ। ঠিক যখন যা করতে চেয়েছেন, তাই-ই করেছেন। কোনো রাখঢাক নেই। শর্মিলা ঠাকুর ভারতীয় সিনেজগতে এক প্রতিভাবান ঝড়ের নাম। যা এসে সমস্ত বাধা-নিষেধ টপকে অন্য জগতে পৌঁছে দিয়েছে। চটকদার কাজ নয়; নিজের অভিনয় প্রতিভার জোরেই সেই জায়গা হাসিল করেছেন তিনি। সিনেমার জগতেই হোক, বা ব্যক্তিগত জীবন— সব জায়গায় সেই সাহসের ছোঁয়া। ১৯৬৫ সাল। দিল্লির স্টেডিয়ামে চলছে ক্রিকেট ম্যাচ। ময়দানে ভারতীয় দলের ক্যাপ্টেন মনসুর আলি খান পটৌডি। নবাব পরিবারের ছেলে; অক্সফোর্ড ফেরত স্মার্ট, শিক্ষিত চেহারা। তাঁর ক্রিকেট-বুদ্ধি ও নেতৃত্বের ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানেই বাচালতা। সেই ম্যাচ দেখতে এসেছেন শর্মিলা ঠাকুর, যিনি ততদিনে বাংলা ও বলিউড দুটি জগতেই প্রসিদ্ধ।
ম্যাচ শেষ হওয়ার পর একটি পার্টিতে একে অন্যের মুখোমুখি হন। পটৌডি খুব একটা সিনেমা দেখেননি, আর শর্মিলাও ক্রিকেট সেরকম বোঝেন না। এছাড়াও দুজনের ব্যক্তিগত জগতটাও আলাদা। কিন্তু শিক্ষা, সৌন্দর্য আর বুদ্ধি যেখানে এক হয়, সেখানে বাকি সব গৌণ হয়ে যায়। তখন থেকে অন্য এক রূপকথার পথ চলা শুরু হয়। টাইগার পটৌডির সঙ্গে বন্ধুত্ব, প্রেম; অতঃপর বিবাহ। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন আচার ব্যবহার— তবুও শর্মিলা অচলায়তন ভাঙার বাণী নিয়েই এগিয়ে এলেন। তাঁর পূর্বপুরুষই যে বাঁধ ভেঙে দেওয়ার গান বেঁধেছিলেন! দুই পরিবারের আপত্তি থাকলেও তা স্থায়ী হয়নি। ‘অপর্ণার সংসার’ যেন সত্যি করেই শুরু হল এবার। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন শর্মিলা ঠাকুর। নতুন নাম হয় ‘আয়েশা বেগম’…
আরও পড়ুন
প্রমথেশ বড়ুয়াই প্রকৃত ‘দেবদাস’, অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন উত্তমকুমার
কিন্তু আপামর ভারতের কাছে তিনি এক এবং অদ্বিতীয় ‘শর্মিলা’। আজকের দিনে, ভারতে দাঁড়িয়ে ভিন্ন ধর্মে বিয়ের অর্থ কী, সেটা নতুন করে বোঝাতে হবে না। তখনও পরিস্থিতি যে খুব অনুকূল ছিল তাও নয়। তবুও এই সাহস দেখিয়েছিলেন শর্মিলা-মনসুর। এখানেই থেমে যাননি। বিয়ের পর কেরিয়ারে ভাটা পড়ে অনেকের। সেভাবে কাজ করা হয়ে ওঠে না। সন্তান হওয়ার পর তো আরওই মুশকিল হয়ে পড়ে। কিন্তু শর্মিলা এখানেও শর্মিলা! বিয়ের পরই ১৯৬৯ সালে মুক্তি পায় ‘আরাধনা’। রাজেশ খান্না-শর্মিলা ঠাকুর জুটি আচ্ছন্ন করে রাখে দর্শককে। আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে যায়; কি অভিনয়ে, কি গানে। এই সিনেমার হাত ধরেই সেরা অভিনেত্রী হিসেবে প্রথম ফিল্মফেয়ারের পুরস্কারটি নেন তিনি। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘আনন্দ আশ্রম’, ‘অমানুষ’— বাংলাতেও একের পর এক অবিস্মরণীয় কাজ করে গেছেন তিনি।
আর এসবের পাশাপাশি সামলেছেন সংসার। বড়ো করেছেন তিন সন্তানকে। সেইসঙ্গে সেন্সর বোর্ডের প্রধান হিসেবেও কাজ করে গেছেন। কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে জুরি হিসেবেও অবতীর্ণ হন। আর এসব সামলে তিনি হয়ে উঠেছিলেন স্বাধীন সত্তার মূর্ত প্রতীক। অপর্ণা যদি বেঁচে থাকত, তবে কাজলকেও বোধহয় এমন যত্নেই মানুষ করত! শর্মিলা ঠাকুর যেন সেইসব অপর্ণাদেরই প্রতীক। মনে পড়ে সেই দৃশ্য, যেখানে সদ্য বিয়ে করে অপু নিজের চিলেকোঠার ঘরে ঢুকছে? দরজা খুলে ভেতরের অন্ধকার সরিয়ে প্রবেশ করল অপর্ণা। জানলার ছেঁড়া পর্দার বাইরে একটি শিশু কেঁদে চলেছে, আর তার মা সামলানোর চেষ্টা করছে। এই দৃশ্যের মাঝখানেই বড়ো হয়ে গেল অপর্ণা। আর অপর্ণার হাত ধরে বেড়ে উঠলেন শর্মিলাও। ঠাকুরবাড়ির সুন্দরী, স্মার্ট মেয়েটির দিকে আজও নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে গোটা ভারত…
তথ্যসূত্র –
১) ‘মনে, রেখে দেব’, ধ্রুবজ্যোতি নন্দী, বাংলা লাইভ
২) ‘ক্রিকেটের সূত্রেই আলাপ, শর্মিলাকে প্যারিসে বিয়ের প্রস্তাব দেন পটৌডী’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘শর্মিলা ঠাকুর: রূপে গুণে তেজস্বিনী এক নক্ষত্রের গল্প’, প্রমা দাস, রোর বাংলা
আরও পড়ুন
'উম্মা'র বদলে 'উমা', বাঘের গর্জনে বেকায়দায় রবি ঘোষ
Powered by Froala Editor