মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের বেলমোন্ট পার্ট। সেখানেই আয়োজন হয়েছে ঘোড় দৌড়ের। বাজি ধরেছেন হাজার হাজার মানুষ। অংশ নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তাবড় অশ্বারোহীরা। সেইসঙ্গে প্রথমবার পেশাদার রেসের মাঠে নেমেছেন এক মার্কিন তরুণও। ফ্র্যাঙ্ক হেইস। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাব সত্ত্বেও একের পর এক খ্যাতনামা জকিদের পিছনে ফেলে লিড নিলেন তিনিই। প্রায় ৬ মিনিটের রুদ্ধশ্বাস রেস। শেষ পর্যন্ত তাঁর ঘোড়া লাফিয়ে পেরিয়ে গেল ফিনিশিং লাইন তথা ফেন্স। তবে ২ মাইলের এই রেস জেতার পরেও অশ্বারোহীর মধ্যে কোনো হেলদোল নেই। নেই উচ্ছ্বাসও। সেদিন একটু অবাকই হয়েছিলেন রেস কোর্সে উপস্থিত দর্শকরা।
১৯২৩ সালে কিংবদন্তি বেলমোন্ট পার্ট (Belmont Part) রেসে এমনই অঘটন ঘটিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক (Frank Hayes)। তবে আরও বড়ো অঘটনের শিকার হয়েছিলেন তিনি নিজে। রেসে জয়ী হলেও, পুরস্কার ট্রফি ছুঁয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। হ্যাঁ, রেস চলাকালীনই মৃত্যু হয়েছিল তরুণ অশ্বারোহীর।
ইতিহাস দেখতে গেলে, আজ থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর অশ্বারোহণ শিখেছিল মানুষ। কাজাখস্তানে পাওয়া গেছে তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ। তারপর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সভ্যতাতেই মানুষের অন্যতম বাহন তথা পরিবহনের মাধ্যম হয়ে উঠেছে অশ্ব। তবে কোনোকালেই সহজ ছিল না অশ্বারোহণ। ঘোড়ায় চড়তে গেলে যেমন বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন পড়ে, তেমনই থাকে চোট লাগার আশঙ্কা। এমনকি অশ্বারোহণের সময় কখনও কখনও ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে যাত্রীর। তবে ফ্র্যাঙ্কের ঘটনাটা ছিল একটু অন্যরকম। ঘোড়া থেকে পড়ে যাননি তিনি। অশ্বারোহণ করতে করতেই ঘোড়ার পিঠে মারা গিয়েছিলেন তিনি। এবং মৃত্যুর পর একই অবস্থায় বসে পেরিয়েছিলেন ফিনিশিং ফেন্সিং। তবে কীভাবে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর?
রেস শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও ফ্র্যাঙ্ককে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামতে না দেখে টনক নড়ে রেস আয়োজকদের। ছুটে আসেন চিকিৎসকরাও। তারপরই প্রকাশ্যে আসে আসল ঘটনা। তৎক্ষণাৎ তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন ট্র্যাক চিকিৎসক ভুয়ারিস হেইস। তাঁর মতে এই রেস শেষ হওয়ার মিনিট খানেই আগেই হৃদরোগে প্রাণ হারান ফ্র্যাঙ্ক। কিন্তু মৃত্যু কি এতই আকস্মিক? নাকি আগে থেকেই অসুস্থ ছিলেন তিনি?
সেইসময়ে এ বিষয়ে একাধিক তত্ত্ব পেশ করেছিলেন হেইস-সহ নানান মার্কিন চিকিৎসক। ১৯২৩ সালের এই রেসই ছিল ফ্র্যাঙ্কের লড়া প্রথম পেশাদার রেস। অনেক চিকিৎসকেরই অভিমত ছিল, উত্তেজনাবশত হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। কেউ আবার বলেন, প্রথমবার এত দ্রুত গতির ঘোড়াদৌড়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাই হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। তবে ট্র্যাক চিকিৎসক হেইসের মতামত ছিল একটু অন্য। এই রেসের আগে, ভালো ফল পাওয়ার জন্য ওজন কমিয়েছিলেন ফ্র্যাঙ্ক। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রায় অর্ধেক করে ফেলেছিলেন নিজের ভার। শরীরের মেটাবলিক হারের আকস্মিক এই পরিবর্তনই ডেকে আনে হৃদরোগে মৃত্যুর সম্ভাবনাকে।
সে যাই হোক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি রেসের ট্রফি তো বটেই, মৃত্যুর পর গিনেস বুকেও নাম তুলেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক। যে রেকর্ড অক্ষত রয়েছে এখনও। হ্যাঁ, ফ্র্যাঙ্কের পরে দ্বিতীয়বার পৃথিবীর বুকে ঘটেনি এমন কোনো ঘটনা। তাঁকে বিশেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছিল নিউইয়র্কের জকি সংগঠনও। জীবনের প্রথম এবং শেষ পেশাদার ঘোড়দৌড়ে পরা রাইডিং সিল্ক গায়েই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁকে। আর তাঁর সেই ঘোড়া? না, সে আর মাঠে নামেনি কোনোদিন। তার গায়ে চেপেছিল অভিশপ্তের তকমা। ‘সুইট কিস’-এর বদলে সে পরিচিত হয়ে উঠেছিল ‘সুইট কিস অফ ডেথ’ নামে…
Powered by Froala Editor