বহির্বিশ্বের শত্রুদের হাত থেকে পৃথিবীকে তথা মানবজাতিকে রক্ষা করাই তাঁদের কাজ। হ্যাঁ, কথা হচ্ছে মার্ভেল সুপার হিরো ‘অ্যাভেঞ্জার’-দের নিয়ে। বিগত এক দশক ধরে একের পর এক বক্স অফিসে রেকর্ড গড়েছে এই সাইফাই সিনেমা সিরিজ। দেখতে গেলে এই অ্যাভেঞ্জার্স সিরিজের শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে। ‘ক্যাপটেন আমেরিকা’-র সেই গল্প মন গড়া হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাস্তবিকভাবেই অংশ নিয়েছিলেন ‘অ্যাভেঞ্জার’-রা (Avengers)। না, সুপারহিরো নন তাঁরা। সাধারণ মানুষই। নাৎসিদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাই ছিল এই ইহুদি বিপ্লবী গোষ্ঠীর (Jews Resistance group) মূল লক্ষ্য।
১৯৩৯ সালেই পোল্যান্ড দখল করেছিল জার্মানরা। ১৯৪১ সালে হিটলারের দল অধিগ্রহণ করে লিথুয়ানিয়াও। সেখানেও চলত ইহুদিদের ওপর অকথ্য অত্যাচার। সেনাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানানোর সুযোগ ছিল ঠিকই, কিন্তু সুবিচার পেতেন না কেউ-ই। বরং, ফল হত ঠিক উল্টো। দোষীদের পরিবর্তে অভিযোগকারীকেই শাস্তি দিত নুরেমবার্গের আদালত। এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলতেই জন্ম হয় অ্যাভেঞ্জার্সের। ১৯৪২ সালের ২১ জানুয়ারি তৈরি হয় ‘ইউনাইটেড পার্টিজান অর্গানাইজেশন’ (এফপিও)। উল্লেখ্য ইউরোপের বুকে এটিই ছিল প্রথম ইহুদি প্রতিরোধ সংগঠন। জার্মানি, পোল্যান্ড তো বটেই, গোটা ইউরোপের ইহুদি ঘেটোগুলিতেই কম-বেশি লুকিয়ে থাকতেন এই সংগঠনের সদস্যরা। বিপ্লবী গোষ্ঠীটির নেতৃত্ব দিতেন খ্যাতনামা লেখক আব্বা কোভনার, জোসেফ গ্লাজম্যান এবং ইটজাক উইটেনবার্গ।
প্রাথমিকভাবে জিউ অ্যাভেঞ্জারদের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন জার্মান শিল্পাঞ্চল এবং সামরিক সামগ্রী উৎপাদনকারী কারখানাগুলিতেই ধ্বংসলীলা চালানো এবং ঘেটোগুলিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। পরবর্তীতে নাৎসিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবের পথকেই বেছে নেয় এফপিও। তাঁদের ‘পেশা’ হয়ে দাঁড়ায় নাৎসি শিকার। জার্মান সেনাবাহিনীর নজর এড়ায়নি বিষয়টা। ঘেটোগুলিতে শুরু হয় ধরপাকড়, চিরুনি তল্লাশি। অন্যদিকে অস্ত্রের পরিমাণও ছিল সীমিত। কাজেই হার যেন নিশ্চিত ছিল তাঁদের।
তবে ক্রমশ বদলাতে থাকে যুদ্ধের পরিস্থিতি। ওয়েরম্যাচের যুদ্ধে রেড আর্মির কাছে হার মানে নাৎসিরা। তারপর ক্রমশ একের পর এক যুদ্ধে পিছু হটতে থাকে জার্মান সেনাবাহিনী। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ১৯৪৪ সালে রেড আর্মিতে যোগদান করেন এফপিও-র সদস্যরা। একদিকে যেমন চলত সেনাবাহিনীর সামনের সারিতে থেকে প্রতিরোধ, তেমনই অন্যদিকে ইহুদি ঘেটোগুলিতে নাৎসি বিরোধী প্রচারও চালাতেন তাঁরা। ‘চোখের বদলে চোখ’-ই মন্ত্র হয়ে উঠেছিল অ্যাভেঞ্জারদের।
আরও পড়ুন
৭ হাজারেরও বেশি শিশুকে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ‘দ্বিতীয় মা’
তবে এই যুদ্ধ থেমে থাকেনি বিশ্বযুদ্ধের পরেও। সোভিয়েত কিংবা আমেরিকার হাতে বহু নাৎসি বন্দি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু অনেকেই সুযোগ বুঝে পালিয়েছিলেন জার্মানি ছেড়ে। পাশাপাশি বিচারে বহু নাৎসি আধিকারিককেই লঘু সাজা দিয়েছিল ট্রাইবুনাল। তাঁদেরকেই যোগ্য শাস্তি দেওয়ার ‘ভার’ নিজের কাঁধে তুলে নেন ইহুদি অ্যাভেঞ্জাররা। স্পেন, কানাডা, পশ্চিম জার্মানি এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে রীতিমতো নাৎসি শিকার অভিযান চলত এফপিও-র। কখনো রহস্যজনক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যেতেন নাৎসি আধিকারিকরা। কখনও আবার প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে দেওয়া হত তাঁদের দেহ। ঠিক কতজন নাৎসি বিদ্ধ হয়েছিলেন অ্যাভেঞ্জার্সের প্রতিশোধের ফলায়— তার সঠিক হিসেব নেই কোনো।
আরও পড়ুন
নাৎসিদের হাতে লুঠ হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে, নিলামে ভ্যান গঘের আঁকা সেই ছবিই
এখানেই শেষ নয়। হলোকাস্টে সব মিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬০ লক্ষ ইহুদি। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁদের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে জার্মান গণহত্যারও ছক কষে এফপিও। ঠিক হয় নুরেমবার্গ, মিউনিখ, হামবার্গ, ফ্রাঙ্কফুট-সহ বড়ো জার্মান শহরগুলির মিউনিসিপ্যালিটির জলের ট্যাঙ্কে মিশিয়ে দেওয়া হবে ঘাতক বিষ। তৎকালীন হিসেব অনুযায়ী, তাতে প্রাণ হারানোর সম্ভাবনা ছিল প্রায় ৬০ লক্ষ জার্মানের। আর এই সিক্রেট প্রোজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় কিংবদন্তি রসায়নবিদ এফ্রাইম কাটজিরকে। পরবর্তীকালে যিনি ইজরায়েলের চতুর্থ প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে।
আরও পড়ুন
সংগ্রহে ৮ হাজার নাৎসি প্রত্নসামগ্রী! অপরাধী ধরতে গিয়ে হতবাক পুলিশ
না, সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় অর্থের অভাবে। প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের জন্য বিষ তৈরি করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল এফ্রাইমের পক্ষে। তবে ‘অপরেশন’ একেবারে বাতিল না করে, ছোটো পরিসরে তা প্রয়োগ করা হয় দাচাই এবং নুরেমবার্গের কারাগারে। জার্মান যুদ্ধবন্দিদের পানীয় জলে মিশিয়ে দেওয়া হয় আর্সেনিক। ১৯৪৬ সালের ২৩ এপ্রিল প্রাণ হারান প্রায় চার শতাধিক নাৎসি সেনা। আক্রান্ত হয়েছিলেন ২২৮৩ জন যুদ্ধবন্দি। তাছাড়াও বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারাগারের জেলার হয়েও গণহত্যা চালিয়েছেন বহু অ্যাভেঞ্জার। বরফগলা জলে আকণ্ঠ ডুবিয়ে রেখে প্রায় ২০০০ নাৎসিকে হত্যা করেছিলেন পোলিশ জেলার সলোমন মোরেল।
ইহুদি বিপ্লবীদের এই কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসতেই সক্রিয় পদক্ষেপ নেয় ইউরোপিয় শক্তিধর দেশগুলির গোয়েন্দা সংস্থা। গ্রেপ্তার করা হয় বহু ‘অ্যাভেঞ্জার’-কে। ইজরায়েলের অন্যতম কবি তথা এফপিও প্রতিষ্ঠাতা কোভনার স্বয়ং গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মিশর থেকে। তারপর ১৯৫০-এর দশকে ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। তবে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে এই কর্মযজ্ঞ সত্যিই কি বিপ্লব ছিল? না, প্রতিরোধের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পরেই যেন ইতি পড়েছিল বিপ্লবে। বাকি যা ছিল, তা শুধুমাত্র প্রতিশোধস্পৃহা…
Powered by Froala Editor