কথায় আছে, ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’ ব্যাপারটা কথা বলার ক্ষেত্রেও নিঃসন্দেহে প্রযোজ্য। নিজেদের অজান্তেই বাক্যালাপের সময় আমরা অনেকক্ষেত্রে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করে থাকি, যা খারাপ লাগার কারণ হয়ে দাঁড়ায় অন্য মানুষের। তৈরি হয় ভুল বোঝাবুঝি। কিন্তু কোনো শব্দের ভুল ব্যবহারের জন্যই যদি প্রাণ দিতে হয় লক্ষাধিক মানুষকে?
আজ থেকে প্রায় আট দশক আগে, একটি শব্দের ভুল প্রয়োগের সূত্র ধরেই লিখিত হয়েছিল ইতিহাসের এক অন্ধকার অধ্যায়। প্রাণ হারাতে হয়েছিল দেড় লক্ষাধিক মানুষকে। হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের পারমাণবিক বোমা (Atomic Bomb) বিস্ফোরণ। জাপানের বুকে এমন বিধ্বংসী দু-দুটি বোমা বিস্ফোরণ আদৌ প্রয়োজন ছিল কিনা, তা নিয়ে আজও ভিন্নমত পোষণ করেন যুদ্ধবিশারদরা। মজার বিষয় হল, ১৯৪৫ সালে, জাপানে পারমাণবিক বোমাবর্ষণের আগে ঠিক একইভাবে দ্বিবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল মার্কিন শিবিরও। তবে তা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত এই কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। নেপথ্যে জাপানি সম্রাট হিরোহিতোর (Emperor Hirohito) একটি মন্তব্য।
ঐতিহাসিক এই মন্তব্যটির প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। আগে এই ঘটনার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে একটু বলে রাখা যাক। ১৯৪৫ সালের জুন মাস। ইতালি এবং জার্মানি ইতিমধ্যেই পর্যুদস্ত হয়েছে মিত্র বাহিনীর কাছে। কেবলমাত্র যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে জাপান। অবশ্য মিত্রশক্তির অংশ হলেও, তখনও পর্যন্ত জাপানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাপানের প্রতিপক্ষ মূলত যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন।
দীর্ঘ ৬ বছরের যুদ্ধে সে-সময় অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে জাপান। ফুরিয়ে এসেছে যুদ্ধের রসদ। শক্তিশালী জাপানি নৌবহরের একটা বড়ো অংশেই ডুবেছে সমুদ্রের জলে। তার ওপরে ইতালি এবং জার্মানির আত্মসমর্পণের পর আরও নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠে জাপান, হয়ে ওঠে কোণঠাসা। এমত পরিস্থিতিতে, আজ না-হয় তো কাল আত্মসমর্পণ করতেই হবে— সে-ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিত ছিলেন জাপানের রাজনীতিবিদদের একাংশ। এমনকি প্রশাসনিক স্তরে তখন কথাবার্তাও শুরু হয়ে গিয়েছিল আত্মসমর্পণের পরিকল্পনা নিয়ে।
অবশ্য উচ্চপদস্থ সেনা আধিকারিক ও রাজনীতিবিদরা আত্মসমর্পণের কথা ভাবলেও, হার মানতে নারাজ ছিলেন জাপানি সেনা এবং জেনারেলরা। আত্মসমর্পণের থেকে যুদ্ধের ময়দানে লড়তে লড়তে প্রাণ দেওয়াই ছিল তাঁদের গর্বের প্রতীক। ফলে, উল্টোদিকে তাঁরাও সাধারণ মানুষকে বোঝাতে শুরু করেন জাপান সাময়িকভাবে ধরাশায়ী হয়ে পড়লেও, খুব তাড়াতাড়িই মোড় ঘুরবে যুদ্ধের।
যুদ্ধবাদীদের এই মানসিকতাই এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছিল জাপানি সম্রাট হিরোহিতোকে। আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ ঘোষণা করলেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবে জাপানের সেনারা— তা একপ্রকার নিশ্চিত। সে-ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হতে পারে পরিস্থিতি। আবার আত্মসমর্পণ ঘোষণা না-করলেও ক্রমশ বাড়তে থাকবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। শেষ পর্যন্ত মধ্যবর্তী একটি পথ খুঁজে বার করেছিলেন জাপান সম্রাট। আর তা হল, শান্তিচুক্তি স্থাপন।
১৯৪৫ সালের জুন মাস। হিরোহিতোর নির্দেশে জাপানের প্রধানমন্ত্রী কোকি হিরোতো সরাসরি সাক্ষাৎ করেন জাপানে অবস্থানরত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। তিনি শান্তিচুক্তি স্থাপনের প্রস্তাব রাখলেও, বিষয়টিকে খুব একটা আমল দেয়নি সোভিয়েত কর্তৃপক্ষ। এর ঠিক এক মাস পরে, ১২ জুলাই ফের সোভিয়েতের কাছে শান্তিচুক্তির আবেদন পেশ করে জাপান। চিঠি নিয়ে সেবার রাশিয়ায় পৌঁছান খোদ জাপানের যুবরাজ। অবশ্য তাতেও মন গলেনি স্তালিনের। জাপানিদের চাতুরি হিসাবেই তিনি দেখেছিলেন বিষয়টিকে।
হ্যাঁ, সরকারি নথি বলছে এমনটাই। ১৯৪৫-এর ২৬ জুলাই জার্মানির পটাসডামে আয়োজিত সম্মেলনে স্বয়ং স্তালিন এ-কথা জানিয়েছিলেন হ্যারি ট্রুম্যানকে। উল্লেখ্য, এই সম্মেলনেই ঠিক হয়, জাপান আত্মসমর্পণ না-করলে চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে মিত্রশক্তি। নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে জাপানের একটা বড়ো অংশ। আর যদি আত্মসমর্পণ করে জাপানি বাহিনী তবে অক্ষত থাকবে সম্রাটের সিংহাসন। রেডিও মারফত ঘোষণার মাধ্যমে সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল জাপানে।
যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব যে হিরোহিতোকে আকৃষ্ট করেছিল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। এমনকি জেনারেলদের বিরোধিতা সত্ত্বেও, সেদিনই যুদ্ধবিরতি ও আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় জাপানের মন্ত্রিসভায়। অবশ্য আত্মসমর্পণের নথি প্রস্তুত করে ফেললেও, তা মিত্রপক্ষের হাতে হস্তান্তর করার জন্য খানিক সময় নেন হিরোহিতো। মূলত দুটি কারণ রয়েছে তার। প্রথমত, মিত্রশক্তি আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করেছে রেডিও-তে। লিখিতভাবে কোনো পত্রই এসে পৌঁছায়নি জাপানে। দ্বিতীয়ত, শান্তিচুক্তি স্থাপনের জন্য সোভিয়েত পাঠানো চিঠিরও উত্তর আসেনি কোনো। সেক্ষেত্রে আকস্মিক আত্মসমর্পণ যদি হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়? যদি ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় সিংহাসন থেকে?
এবার ফিরে যাওয়া যাক সেই ঐতিহাসিক ‘ভুল’ শব্দপ্রয়োগের গল্প। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটা ছিল ২৮ জুলাই। সাংবাদিক সম্মেলনে হিরোহিতোকে প্রশ্ন করা হয়, মিত্রশক্তির হুমকির প্রেক্ষিতে কী ভাবছেন তিনি? বলাই বাহুল্য, পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে তখনও দোলাচলে হিরোহিতো। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এককথায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মোকুসাৎসু’ (Mokusatsu)। জাপানি এই শব্দটি আদতে দ্ব্যর্থক। অর্থাৎ, দুটি অর্থ রয়েছে তার। প্রথমটি হল ‘ইগনোর উইথ কন্টেম্পট’ বা তুচ্ছ হিসাবে উপেক্ষা করা। অন্যটি হল, ‘নট টু কমেন্ট’ অর্থাৎ, কোনো মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকা।
হিরোহিতো দ্বিতীয় অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন ‘মোকুসাৎসু’ শব্দটি, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। তবে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এবং মিত্রশক্তির রাষ্ট্রনেতারা ধরেছিলেন, তাঁদের প্রস্তাব আদতে উপেক্ষা করছে জাপান। অর্থাৎ, আত্মসমর্পণে রাজি নয় তারা। এরপরই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের রায়ে স্বাক্ষর করেন হ্যারি ট্রুম্যান। ৬ ও ৯ আগস্ট ধ্বংস হয়ে যায় জাপানের দুটি অন্যতম শহর। আরও একটি বোমা প্রস্তুত ছিল টোকিও-র জন্যও। তবে তার আগেই জাপানের আত্মসমর্পণে ইতি পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। অথচ, হিরোহিতোর মন্তব্য খানিক স্পষ্ট হলেই হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যেত এই বিপর্যয়। প্রাণ বাঁচত দেড় লক্ষাধিক মানুষের। অবশ্য আজও বিতর্ক রয়েছে হিরোহিতোর এই মন্তব্যই কি একমাত্র কারণ ছিল এই সিদ্ধান্তের? তাঁর কথার আসল অর্থ বুঝতে পারলেও কি আদৌ পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে বিরত থাকত যুক্তরাষ্ট্র? তা-নিয়ে আজও বিতর্ক রয়েছে নানা স্তরে। তবে ক্রমশ প্রকাশ্যে আসা গোপন সরকারি নথি অনুযায়ী, এই ঘটনা ছিল জাপানের ‘কূটনৈতিক পরাজয়’ বা ‘ডিপ্লোম্যাটিক ডিফিট’। চাণক্যের কথায় বলতে গেলে, কূটনীতির মূলমন্ত্রই হল শব্দের ব্যবহারে শত্রুকে বশে আনা। আর সেখানেই ডাহা ফেল করেছিলেন হিরোহিতো।
Powered by Froala Editor