‘পুরীর জগন্নাথ মন্দির আসলে একটি বৌদ্ধ মন্দির’ - বলেছিলেন বিবেকানন্দ, বুদ্ধের দন্তযাত্রার অনুকরণেই শুরু রথযাত্রা!

প্রশস্ত রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তিনটে বিশালাকৃতির কাঠামো। তাকে ঘিরে রয়েছে জনসমাগম। কাঠামোগুলোর পেছনে দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ মন্দির। সেই কবে থেকে এমন ছবিই সিগনেচার হয়ে আছে। মানুষমাত্রেই চিনবেন এই মন্দিরকে। কথা হচ্ছে পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরের সম্পর্কে। কত মিথ, ইতিহাস, ধর্মীয় কাহিনি জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। আর রথযাত্রার প্রসঙ্গ তো আছেই। ওড়িশার এমন কিংবদন্তি মন্দিরের সঙ্গে অনেকেরই অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। তার ইতিহাস ঠিক কী বলে আমাদের? সূচনালগ্ন থেকে কীভাবে পৃথিবীর বদলের ধারা দেখে এসেছে জগন্নাথ দেবের এই মন্দির?

এমন প্রশ্ন এবং সেই সম্পর্কিত তথ্যাদি পেলে আমাদের আটকে রাখা মুশকিল। কিন্তু এই লেখার শিরোনাম দেখে খানিক শঙ্কা জাগতে পারে। পুরীর মন্দির তৈরির নানা কাহিনি তো আমরা জেনেছি। সেখানে বৌদ্ধ তত্ত্ব কোথা থেকে এল? বিভিন্ন লেখা, ঐতিহাসিকদের দলিল এবং প্রাচীন পুঁথিতে এমন একটি বিষয়ই উঠে এসেছে। এমনকি, স্বামী বিবেকানন্দও এই ব্যাপারটি নিয়ে নিজের কথা বলে গেছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘জগন্নাথ মন্দির একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির। আমরা ঐটিকে এবং অন্যান্য বৌদ্ধ মন্দিরকে হিন্দু মন্দির করিয়া লইয়াছি।’ অর্থাৎ, আজকের জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা এবং তাঁদের ভক্ত পুরোহিতরা নন, বরং বৌদ্ধদেরই আনাগোনা ছিল এখানে। ভারতের উত্তর ও পূর্ব অংশের অন্যান্য বৌদ্ধ মঠ ও মন্দিরের মতোই এর রূপ বদলে যায়! 

ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম এবং তার প্রসার-প্রচার সম্পর্কে নানা কথা আমরা ইতিহাসে জেনেছি। এও জেনেছি, একটা সময় এইসব অঞ্চলে তৈরি হওয়া বৌদ্ধ ক্ষেত্রগুলির অনেকাংশই আক্রান্ত হয়েছে। হয় ভেঙে ফেলা হয়েছে; নয়তো সেখানে তৈরি করা হয়েছে মন্দির। কিন্তু তার সঙ্গে কি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরও যুক্ত আছে? একা স্বামীজিই নন; আরও অনেকেই এমন কথা বলেছেন। তাঁরা বেশ কিছু বিশেষ দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছেন। আমরা জানি কলিঙ্গ যুদ্ধের কথা। সম্রাট অশোকের চণ্ডাশোক থেকে ধম্মাশোকে পরিণত হওয়ার কাহিনিও অজানা। ওড়িশা কিন্তু সেই সময় কলিঙ্গেরই একটি অংশ ছিল। কাজেই বৌদ্ধধর্মাবলম্বী অশোক এবং তাঁর পরবর্তী রাজাদের প্রভাব যে সেখানে ভালোমতো পড়বে, সেটা বলাই যায়। পরবর্তীকালে শবররা ওড়িশা দখল করে। সেই কাহিনি আলাদা; কিন্তু তার আগের? অনেক ঐতিহাসিকরা নজর রেখেছেন জগন্নাথ মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে। নানা চিত্রকর্ম সেখানে শোভা পাচ্ছে। তারই মধ্যে অনেক চিত্র ও কাজের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্ম ও তন্ত্রের মিল আছে। সেটা কি খুবই কাকতালীয়? 

এখানেই শেষ নয়। ঐতিহাসিকরা চোখ রেখেছেন মন্দিরের তিন বিগ্রহের ওপরেও। জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রা— সেই কবে থেকে এই তিনজনের উপাসনা করে আসছি আমরা। একটা সময় এই বিগ্রহ তিনটি জঙ্গলের ভেতর ছিল। সেখান থেকে এই মন্দিরে নিয়ে এসে পুজো করা শুরু হয়। এই বিগ্রহের সঙ্গেও বৌদ্ধ ধর্মের নিদারুণ মিল পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বৌদ্ধ ধর্মের দিকে একটু নজর দিলে তিনটি মূর্তির প্রসঙ্গ আসবে— বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ। এদের মধ্যে ধর্ম-কে নারীরূপে কল্পনা করা হয়। এবং, এদের অবয়ব বলে সেরকম কিছু নেই; চোখ, নাক আর অর্ধ চন্দ্রাকৃতি ওষ্ঠ। বুদ্ধ, ধর্ম, সংঘ— পাশাপাশি রাখলে এরকম আরও একটি ত্রয়ী মূর্তির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে না?

আরও পড়ুন
চৈতন্যদেব নাম দিয়েছিলেন ‘নব-নীলাচল’, বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে শ্রীরামপুর

এছাড়াও রয়েছে আরও কিছু অদ্ভুত তথ্য। বেশ কিছু গবেষকের বক্তব্য, ভারতের যত হিন্দু দেবালয় বা মন্দির আছে, তাদের কারোরই প্রবেশপথ পূর্বদিকে নয়। একমাত্র পুরীর শ্রীক্ষেত্রের প্রবেশপথ পূর্বদিকে। এদিকে বৌদ্ধ মন্দির ও মঠের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, সেখানেও সমস্ত প্রবেশপথের অবস্থান সেই পূর্বেই! বিশেষজ্ঞদের মতে, একটা সময় যখন ওড়িশা ও কলিঙ্গ থেকে বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ পিছু হটছে, তখনই জগন্নাথ মন্দিরের উৎপত্তি। এক সময় যেখানে একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল, সেটাকেই গড়ে তোলা হয় বৈষ্ণব তীর্থস্থল হিসেবে। আর রামানুজের সময় থেকেই এই বৈষ্ণব ভাবের প্রবেশ। যার সম্পূর্ণ বিকশিত রূপ দেখা যায় চৈতন্যদেবের আগমনের পর। 

পুরীর মন্দির তো বটেই, এমন বিতর্কিত আলোচনায় উঠে এসেছে বিখ্যাত রথযাত্রার কথা। আজ যে উৎসব শুধু পুরীতে সীমাবদ্ধ নেই। গোটা বিশ্ব থেকে মানুষ আসে এইসময়। এই রথযাত্রার ঐতিহ্য কতটা প্রাচীন? এখানেও কি রয়েছে বৌদ্ধ প্রভাব? বেশ কিছু ঐতিহাসিক অন্তত তাই-ই বলছেন। দেশীয় ইতিহাসবিদ, বিশেষজ্ঞরা তো বটেই, বিদেশী ঐতিহাসিকদের গবেষণাও এমন প্রসঙ্গ তুলে এনেছেন। বৌদ্ধদের মধ্যে ‘দন্তযাত্রা’ বলে একটি প্রথা প্রচলিত আছে। যেখানে বছরে একবার বুদ্ধের দাঁত নিয়ে একটি শোভাযাত্রা নির্গত হত। একটা সময় ওড়িশাতেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম হান্টারের গবেষণা বলে, বৌদ্ধরা এখানে বুদ্ধের দুটি দাঁত নিয়ে আসেন। প্রতি বছর সেগুলোকে নিয়ে রথের মতো কিছুর ওপর বসিয়ে শোভাযাত্রা বেরোত। সেই উপলক্ষে মেলা, জনসমাগম হত। পরে বৌদ্ধ ধর্ম যখন এই অঞ্চল থেকে আস্তে আস্তে পিছনে সরে গেল; তখন ভিক্ষুরা দাঁত দুটিকে নিয়ে সিংহল অর্থাৎ শ্রীলঙ্কায় চলে গেল। কিন্তু রয়ে যায় এই উৎসবটি। সেখান থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েই নাকি শুরু হয় আজকের রথযাত্রা! 

আরও পড়ুন
বন্ধ হবে না পুরীর রথযাত্রা, শর্তসাপেক্ষে অনুমতি সুপ্রিম কোর্টের

খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের শাস্ত্রে বিষ্ণুর দশাবতারের যে বর্ণনা রয়েছে, তার একজন হলেন বুদ্ধ। বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্মের একটি অংশ হিসেবে প্রদর্শন করানোও শুরু হয় তখন থেকে। সেই কারণেই কি বিষ্ণুর অবতার-রূপ হিসেবে বুদ্ধের আগমন? জানা নেই। জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মক্ষেত্রের একাধিক মিল অনেক কিছু নিয়ে আসছে আমাদের সামনে। সত্যিই কি অনেক অদেখা রয়েছে? আমাদের সাধারণ দৃষ্টির আড়ালে কি লুকিয়ে আছে আরও বড়ো কোনো গোপন ইতিহাস? সত্যিই কি বৌদ্ধ মন্দিরের রূপান্তরিত রূপ দেখছি আজ পুরীতে? প্রশ্ন অনেক। গবেষকরাও নানা তথ্য নিয়ে আসছেন সামনে। আর সেই রহস্যের আড়ালে আজও জগন্নাথ মন্দিরের ধ্বজা উড়ে চলেছে; অবিচল… 

তথ্যসূত্র- 

আরও পড়ুন
মোঘল সম্রাটের পর করোনা; এবারের মতো স্থগিত পুরীর রথযাত্রা, নির্দেশ কোর্টের

১) গৌড়ের ইতিহাস, (প্রথম খণ্ড) / রজনীকান্ত চক্রবর্তী
২) স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (পঞ্চম খণ্ড)
৩) বৌদ্ধধর্ম - সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪) শ্রীক্ষেত্র / হেমেন্দ্রকুমার রায়, ভারতী ১৩১৮
৫) বঙ্গদর্শন, ১২৮৫ বঙ্গাব্দ

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
করোনার জেরে ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, এ-বছর পুরীর রথ বেরোবে না পথে

More From Author See More