ধাতুর তৈরি ফাঁপা প্রমাণ আয়তনের একটি মানবমূর্তি। উচ্চতা প্রায় ছ’ফুট। এই মূর্তিকে কাঁধে চাপিয়ে নগরের পরিক্রমায় বেরিয়েছেন কিছু খ্রিস্টান সন্ন্যাসী। তবে একটু কাছে গেলেই নজরে পড়বে এক আশ্চর্য দৃশ্য। মূর্তিটিকে জড়িয়ে রয়েছে কিছু সাপ। না, সেগুলি ধাতব অবয়ব নয়। বরং, তারা জীবিত। কিলবিল করছে অনবরত। আর এই শোভাযাত্রা দেখতে পথের ধারে জড়ো হওয়া হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মাঝেমধ্যেই এসে ছুঁয়ে যাচ্ছেন এইসব সাপেদের (Snakes)।
মধ্য ইতালির (Italy) ছোট্ট শহর কোকুল্লো (Cocullo)। প্রতি বছর মে মাসের পয়লা দিন সেখানে গেলেই দেখা মিলবে এমনই এক আশ্চর্য দৃশ্যের। যা দেখে গা শিরশির করে উঠতে পারে অনেকেরই। কিন্তু এই আশ্চর্য উৎসবের কারণ কী? সাপের মতো বিষধর, ভয়াবহ একটি প্রাণীকে নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়ানো, কতটাই-বা নিরাপদ? উঠে আসে এসব প্রশ্নই।
এই গল্প বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে দশম শতকে। ইতালির নানান শহরে ঘুরে ঘুরে সে-সময় একাধিক মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খ্রিস্টান সন্ত সান ডোমেনিকো অ্যাবেতে। অন্যথা হয়নি কোকুল্লোতেও। ১ মে, এই মঠ প্রতিষ্ঠার দিনকে কেন্দ্র করেই তাই কোকুল্লো-জুড়ে উদযাপিত হয় বিশেষ এক উৎসব। যা একদিকে যেমন বসন্ত ঋতুকে স্বাগত জানায়, তেমনই স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন এই উৎসবেই নাকি সূচনা হয় নতুন বছরের। যাই হোক, এই উৎসবকে কেন্দ্র করেই পথে নামেন সন্ন্যাসী ও খ্রিস্ট-ধর্মাবলম্বী মানুষরা। তাঁরা যে-মূর্তি কাঁধে করে পরিভ্রমণ করেন সারা শহরে, সেটি আর কেউ নন, স্বয়ং সন্ত সান ডোমেনিকোরই অবয়ব।
অবশ্য বছরের একটা দিন এই উৎসব পালিত হলেও, তার প্রস্তুতি চলে প্রায় মাস দুয়েক ধরে। মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে ইতালিতে বরফ গলা শুরু হলে, কোকুল্লোর সেরপারি সম্প্রদায়ের মানুষরা দল বেঁধে রওয়ানা দেন নিকটবর্তী পর্বতশৃঙ্গমাউন্ট ক্যাটিনিতে। সেখান থেকেই ধরে আনেন বিষহীন নানা প্রজাতির সাপ। তারপর কোকুল্লোর মঠে প্রায় দেড় মাস ধরে চলে তাদের পরিচর্যা। প্রতিদিন সেদ্ধ ডিম আর জ্যান্ত ইঁদুর খেতে দেওয়া হয় তাদের। ভেঙে দেওয়া হয় তাদের দাঁত। পয়লা মে-র উৎসবের দিন সান ডোমেনিকোর সঙ্গে তারাও সামিল হয় শোভাযাত্রায়। স্থানীয়দের বিশ্বাস, এই সাপেরা নাকি জলাতঙ্ক থেকে রক্ষা করে মানুষদের। তারা শহরের মানুষদের সুস্বাস্থ্যের প্রতীক। এখানেই শেষ নয়। নতুন বছর কেমন যাবে, সেটাও নির্ধারিত হয় এই সাপেদের মাধ্যমেই। সন্ত সান ডোমেনিকোর মূর্তির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় গোটা পাঁচেক জীবন্ত সাপ। দেখা হয় তাদের গতিবিধি। সাপগুলি এই মূর্তির মাথা ও গলা পেঁচিয়ে ধরলে, মনে করা হয় তা সৌভাগ্যের পূর্বাভাস। আর যদি মূর্তি থেকে অকস্মাৎ পড়ে যায় তারা, তাহলেই আশঙ্কার মেঘ জমা হয় শহরের মানুষের মনে। এমন ঘটনা নাকি খরা কিংবা অনাবৃষ্টির প্রতীক। তবে আগাম দুঃসংবাদ বা বিপর্যয়ের সতর্কতা প্রদান করলেও, মানুষের রোষের শিকার হয় না এইসব সর্পকুল। বরং, উৎসব শেষে রীতিমতো খাইয়ে-দাইয়ে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় প্রকৃতির কোলে।
মজার বিষয় হল, এই আশ্চর্য উৎসব কীভাবে শুরু হয়েছিল, তার স্পষ্ট কোনো উত্তর পাওয়া যায় না আজও। কিছু ঐতিহাসিকের মতে, রোমান ডেমিগড হারকিউলিসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এই আচার। আবার কেউ কেউ দাবি করেন প্রাচীন মার্সি সম্প্রদায়ের মানুষদের দেবী অ্যাঞ্জিজিয়ার থেকেই উৎপত্তি হয়েছিল এই উৎসবের। এই প্রাচীন দেবী বিষধর সাপের থেকে রক্ষা করতেন মানুষদের, এমনটাই বিশ্বাস মার্সিদের। সেই রীতিই কোনোভাবে হয়তো হয়ে উঠেছে খ্রিস্টান কাল্ট।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে আরও এক ভিন্ন তত্ত্ব। সেই তত্ত্ব অনুযায়ী, মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী সেন্ট পল সর্পদংশনের শিকার হয়েছিলেন মালটায় গিয়ে। তবে আশ্চর্যজনকভাবেই প্রাণে বেঁচে যান তিনি। এই ঘটনার পর বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতার কথা প্রচার করেছিলেন তাঁর অনুগামীদের একাংশ। ব্ল্যাকম্যাজিক বা তন্ত্র-মন্ত্রের মাধ্যমে সাপের বিষ নামানোর মতো কার্যকলাপও করতেন তাঁরা। সান ডোমেনিকো অ্যাবেট তাঁদেরই একজন ছিলেন— এমন সম্ভাবনার কথা শোনায় সাম্প্রতিক গবেষণাটি। আর সেই কারণেই নাকি তাঁর মূর্তির সঙ্গে ‘পূজিত’ হয়ে আসছে সাপেরা। একাধিক সমীক্ষায় স্থানীয়রা এই গবেষণাপত্রকে স্বীকৃতি না দিলেও, এই তত্ত্বকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না কোনোভাবেই। কে বলতে পারে এভাবেই হয়তো জন্ম হয়েছিল কোকুল্লোর এই শতাব্দীপ্রাচীন উৎসবের।
Powered by Froala Editor