‘ভাবছি, ওই দোকান গিয়ে বলব দুটো বাচ্চা কেউটে ভালো করে প্যাক করে দিন, অনেক দূরে নিয়ে যাব’।
কাজ সেরে ট্যাক্সিতে ফিরছিলাম দুজন। ঈষৎ ক্লান্ত আমি গাড়ির দুলুনিতে খানিক তন্দ্রাহত। পার্শ্ববর্তী সহকর্মী শিবাজীদা ওরফে পাপাই এর এহেন উক্তিতে তন্দ্রা, সুপ্তি সব ট্যাক্সির জানলা দিয়ে ভাগলবা। টাউন স্কুল পেরিয়ে তখন আমরা শ্যামবাজার পাঁচমাথার কাছাকাছি। সাড়ে সাতশো গ্রাম শঙ্কা আর কিলো খানেক জিগীষা নিয়ে আমাদের রঙ্গ-ব্যঙ্গ-রসিকেষু পাপাইয়ের দিকে তাকালাম। অম্লানবদনে বলল, ও কিছু না, দোকানটার নাম ‘নাগমহল’ কিনা তাই বলছিলুম।
শৈশব থেকে কেশবচন্দ্র নাগের ছোবল খাওয়া প্রজন্মের লোক আমরা। আবার এ তো দেখি একা নাগ নয়, একেবারে নাগমহল। তবে নেহাতই নির্বিষ, জামা-কাপড়ের দোকান।
এ তাবৎ বঙ্গ ভাণ্ডারে বিপণির নামসমুচয় সত্যিই বিবিধ রসকে উথলে দেয়। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে কেষ্টপুরের গলির ভিতর এক অভিমানী চায়ের দোকান একসময়ে গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। দোকান মালিক ভজাদার স্ত্রীর নাম লক্ষ্মী। চা-প্রেমী ভজাদা, পেশা আর প্রেমকে একাকার করে দোকানে সাইন বোর্ড ঝুলিয়েছিলেন, ‘লক্ষ্মীটি স্টল’। স্ত্রী লক্ষ্মী আর চা নামক তার লক্ষ্মীকে এভাবেই বৈদান্তিক অভিন্নতায় বেঁধেছিলেন তিনি।
দোকানের নামকরণে সমকালীন কলকাতা তথা সম্প্রসারিত মহানাগরিক এলাকার ভিতর কেষ্টপুরের নাম অগ্রগণ্য। কারণ বছর কুড়ি আগে এখানেই প্রথম দেখেছিলাম রোলের পুঁচকে দোকানের নাম, ‘খাইবার পাস’। আর এক দশক আগে এরকমই আরেক সাইনবোর্ড, ‘চোখের খিদে’।
বিশ্বায়ন পরবর্তী পৃথিবীতে পেটের ক্ষিদের থেকে চোখের খিদে যে বড় হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের ভিতর। তাত্ত্বিকরা বারবার বলছেন, নেসেসিটি লাক্সারি হয়ে উঠছে আর লাক্সারি নেসেসিটি। এখন নাকি ভাত-রুটির ক্ষিদে নয়, ফ্যান দাও-এর পঞ্চাশী আর্তনাদ নয়, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের অন্তর কাঁদছে ‘পিৎজা-বার্গার’-এর খিদেয়। যাকে বলে, ‘চোখের খিদে’। তাই এতো কেবল নাম নয়, তার্কিক বাঙালির কাছে রীতিমতো ডিসকোর্স।
‘ভজহরি মান্না’, ‘তেরো পার্বণ’, ‘ভূতের রাজা দিল বর’, ‘পেটুক’, ‘সপ্তপদী’ এরকম আরও কতো নামে বাঙালিয়ানা বহন করা কর্পোরেট ব্র্যান্ড মহানগরকে শাসন করে। তবু আজও যখন কলেজস্ট্রিটের ভবানী দত্ত লেনে আজাদ হিন্দ ভাতের হোটেলে পাতের পাশে গন্ধরাজ লেবুটি যখন মাখেন মুসুরির ডালের সঙ্গে, তালতলার চটির শব্দ ভেসে আসে ট্রামলাইন থেকে। আপনার মন স্মৃতিচারণ করে হাতকে বলে, পাগলা, হালকা উৎসর্গ করে খা, ওই তো বিদ্যেসাগর মশায় হেঁটে চলেছেন ফোর্ট উইলিয়ম পানে। অন্নের ঘ্রাণে যুগ পিছিয়ে যায় সুদূরে, স্পর্শ করতে চায় বাঙালির আত্মগরিমার স্পর্ধাটুকু।
কিংবা তরুণ নিকেতনে যখন আপনি গর্ভবতী পাবদার শরীর ভেঙে ডিম উদ্ধার করে সরষের ঝোলে মেখে আধদলা ভাত মুখে তুলছেন, আর আপনার কোষে-কোষান্তরে ছড়িয়ে যাচ্ছে সুধীন দত্তের, সেদিনও এমনই ফসল বিলাসী হাওয়া্...। যত দিন যায় রাসবিহারী মোড়ের ‘তরুণ নিকেতন’-এর বয়স বাড়ে না। তরুণ থেকে তরুণতর হয়।
গৌরীবাড়ি এলাকায় অভিনব নাম নিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এক কাপড় ধোলাই আর ইস্ত্রির দোকান, ‘মলিন মোচন’। নামকরণ করেছিলেন জনৈক মাখনলাল কুণ্ডু, অপরিচ্ছন্নতা ছিল যার দু-চক্ষের বিষ। তাই তাঁর মেজো ছেলে যখন লন্ড্রির ব্যাবসা শুরু করেন, মাখনবাবুই এই নামকরণ করেন।
খান্নার মোড় থেকে হাতিবাগানের দিকে যেতে বাঁদিকে একটি বিলিতি মদের দোকান পথিকের দৃষ্টি কেড়ে নেয় অনিবার্য। সুরারসিক না হলেও এই দোকানের নাম যিনি একবার পড়ে ফেলেছেন, ভুলতে পারা কঠিন। সেই নামটি হল, ‘এই তো সুধা’।
মহানগর কীর্তন পেরিয়ে এবার মফঃস্বলের রাস্তাতে হাঁটি। বেলুড়ে একটি সেলুনের নাম, ‘কিমকর্তনম’। সোনারপুরে একটি বিউটি পার্লারের নাম ‘রূপলাগি’। আর তরুণ লেখক সম্বিত বসু হুগলির জাঙ্গীপাড়ার একটি চালের দোকানের নাম রেখেছেন, ‘অন্নদামঙ্গল’।
নাম-সংকীর্তনের শেষে ঘরে ফেরার পথে এসে দাঁড়াই। কৈশোর থেকেই সিঁথির পাশে পালপাড়ার এই সাইনবোর্ড যেন কুহকের মতো টানে। অক্ষরগুলো নিয়ে যায় কোনো সনাতন শিকড়ের দিকে। ভরপুর নগর জীবনের মাঝে এক টুকরো পল্লীছায়া রচনা করে দাঁড়িয়ে থাকে দশকর্মা ভাণ্ডার, ‘মাটির সংসার’।
ঋণ- সোমনাথ শর্মা, অনির্বাণ বসু
Powered by Froala Editor