হালকা ঝিম ধরা আলো পানশালায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মানুষ বসে রয়েছে চারিদিকে। হাতে ধরা গ্লাস। নেশায় ডুব দিচ্ছেন তাঁরা। এই আবহকে যেন আরও মাতাল করে তুলছে লাইভ মিউজিক। অ্যাকোর্ডিয়ান বাজিয়ে গান গাইছেন যুক্তরাষ্ট্রের লাইসিয়ানা প্রদেশের খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াটসন। তাঁর গলায় অনুরণিত হচ্ছে কিংবদন্তি ফরাসি গান ‘ওহ, বাই বাই’। গানের তালে তাল মিলিয়ে কেউ কেউ ততক্ষণে নাচতেও শুরু করে দিয়েছেন বারের মধ্যে। এমন সময় হঠাৎ করেই খেলে গেল চমক। সুর এক, বদলে গেল গানের ভাষা। বারে উপস্থিত অনেকের কাছেই যে ভাষা সম্পূর্ণ অচেনা, আনকোরা।
কৌরি-ভিনি (Kouri-Vini)। না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ভাষা নতুন নয়। তবে বর্তমানে এই ভাষা সম্পূর্ণভাবে অবলুপ্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বুক থেকে। আর হারিয়ে যাওয়া এই ভাষায় নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করতেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ওয়াটসন। শুধু তিনি একা নন, চেষ্টা চালাচ্ছেন লুইসিয়ানা (Louisiana) প্রদেশের বহু বুদ্ধিজীবীই।
ফরাসি, ইংরাজি এবং বিভিন্ন আফ্রিকান ভাষার সংমিশ্রণে তৈরি কৌরি-ভিনি। তার ইতিহাসও বেশ বৈচিত্র্যময়। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, লুইসিয়ানা আদতে মার্কিন নাম নয়। এমনকি সেখানকার স্থানীয় ডায়েলেক্টকেও বলা হয় ‘ফ্রেঞ্চ লুইসিয়ানা’ ডায়ালেক্ট। তার কারণ, একটা সময় এই অঞ্চল ছিল ফরাসি উপনিবেশ। সেটা ১৬৮২ সাল। ফরাসি সম্রাট ষোড়শ লুইস এই অঞ্চলটির দখল নেন। এর বছর তিরিশেক পর থেকেই ক্রীতদাস ব্যবসার কেন্দ্র হয়ে ওঠে লুইসিয়ানা। ফরাসি জাহাজে চাপিয়ে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা হত ক্রীতদাস। তারপর অর্থের বিনিময়ে তাঁদের তুলে দেওয়া হত ফরাসি এবং স্থানীয় আমেরিকানদের হাতে।
আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ক্রীতদাসরা ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত। এদিকে আবার লুইসিয়ানাতেও তখন দুটি প্রধান ভাষা চলে— ইংরাজি এবং ফরাসি। ফলে, সবকটি ভাষাকে মিশিয়ে আফ্রিকান ছন্দে এক নতুন কথ্য ভাষার জন্ম দিয়েছিলেন অষ্টদশ শতকের আমেরিকা-বাসী ক্রীতদাসরা। যা পরিচিতি পায় ‘কৌরি-ভিনি’ বা ‘ক্রেওল’ নামে। যে-কারণে আজও এই অঞ্চলের ডাকনাম ‘ক্রেওল’।
তবে মজার বিষয় হল, শুধুমাত্র ক্রীতদাস কিংবা কৃষ্ণাঙ্গরাই নন, শ্বেতাঙ্গদের একাংশও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন এই ভাষার সঙ্গে। বিশেষত মার্কিন শিশুরা, ক্রীতদাসদের যত্নে মানুষ হয়ে ওঠার ফলে, তারা সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন এই ভাষায়। তাদের মুখে মুখেই এই ভাষা রীতিমতো ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা লুইসিয়ানায়।
১৮১৩ সালে প্রথম ধাক্কা খায় প্রাচীন এই ভাষা। ফরাসি প্রশাসনের থেকে অর্থের বিনিময়ে লুইসিয়ানা কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর তারপরই শুরু হয় ফরাসির অস্তিত্ব মুছে, ইংরাজি চাপিয়ে দেওয়ার প্রকল্প। সে-সময় ইংরাজি শিক্ষা বাধ্যবাধকতায় পরিণত হলে, ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসে কৌরি-ভিনি। তবে অস্তিত্ব একেবারেই মুছে যায়নি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দাসত্ব প্রথা অবলুপ্ত হওয়ার পর বহু শ্বেতাঙ্গই সংসার বেঁধেছিলেন কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে। তাদের মুখে মুখেই বেঁচে ছিল এই প্রাচীন কথ্য ভাষা। তবে এই ভাষার কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দেশের মানুষকে সে-সময় জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে ‘এক দেশ, এক ভাষা’ প্রকল্প শুরু করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট। ইংরাজি ছাড়া অন্য সমস্ত ভাষাকেই অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল সে-সময়। যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের পরই প্রায় সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায় কৌরি-ভিনি।
আশায় বিষয় হল, বিগত এক দশক ধরে ফের নতুন করে শুরু হয়েছে এই ভাষার চর্চা। নেপথ্যে লুইসিয়ানার স্থানীয় ইতিহাস গবেষক এবং বুদ্ধিজীবী এবং শিল্পীরা। তাঁদের উদ্যোগেই লুইসিয়ানা হিস্টোরিক অ্যান্ড কালচারাল ভিস্তাসে শুরু হয়েছে অনলাইন কৌরি-ভিনি ক্লাস। সেইসঙ্গে অনলাইন মিডিয়া চ্যানেলের মাধ্যমে প্রাচীন ‘ক্রেওল’ ভাষাটির নানা অনুষ্ঠানও প্রচার করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে। গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে, কৌরি-ভিনির ইতিহাস, উৎস। এই উদ্যোগে জড়িত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিদ অলিভার মায়েক্স, সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াটসনের মতো মানুষরাও। যে ওয়াটসনের কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল এই গল্প। খ্যাতিকে কাজে লাগিয়েই সাধারণ মানুষের মধ্যে নেমে তিনি প্রচার করছেন হারিয়ে যাওয়া ভাষাটির। এমনকি চলতি বছরেই কৌরি-ভিনি ভাষায় প্রকাশ পেতে চলেছে তাঁর একটি গানের অ্যালবাম। প্রচলিত বিভিন্ন ইংরাজি গানকেই তিনি অনুবাদ করেছেন কৌরি-ভিনিতে।
এই উদ্যোগের ফলাফলও বেশ ইতিবাচক। যেখানে এই শতকের গোড়ার দিকে হাতে গোনা কিছু মানুষ কথা বলতে পারতেন এই ভাষায়, সেখান আজ সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৬০০০-এর কাছে। কাজেই আগামীদিনে আঞ্চলিক পরিসরে হলেও, এই ভাষায় নতুন করে প্রাণস্পন্দন ফিরবে বলেই মনে করছেন লুইসিয়ানার ভাষাবিদরা…
Powered by Froala Editor