দুই বিশ্বযুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্রিটেন, জার্মানি, আমেরিকা, ইতালি, ফ্রান্স কিংবা রাশিয়ার নাম। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সে-যুগে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনী ছিল ভারতের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই একের পর এক যুদ্ধে জার্মান সেনাদের সামনে পর্যুদস্ত হয় ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। জার্মান আক্রমণ ঠেকাতে তাই ভারতীয় সৈনিকদের বিশ্বযুদ্ধে পাঠানো শুরু করে ঔপনিবেশিক শাসকরা। সবমিলিয়ে প্রায় বিশ্বযুদ্ধে (World War I) ভারতের বাইরে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে লড়েছিলেন ১০ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় সেনা (Indian Soldiers)। কিন্তু কেমন ছিল তাঁদের প্রতিক্রিয়া? রণক্ষেত্রে কোন কোন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁদের?
শ্বেতাঙ্গ সেনাদের এহেন অভিজ্ঞতার কাহিনি নিয়ে গ্রন্থ রয়েছে অজস্র। যা নিয়ে পরবর্তীতে তৈরি হয়েছে সিনেমাও। তবে ভারতীয় সৈনিকদের লেখা বিশ্বযুদ্ধের জবানির উদাহরণ বিরল বললেই চলে। বাংলা থেকে বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া বহু সৈনিকই কাজের ফাঁকে বসে পড়তেন খাতা-কলম নিয়ে। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা, ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং পাশবিকতার বর্ণনা লিখতেন তাঁরা। চিঠি হিসাবে পাঠাতেন প্রিয়জনদের কাছে। যার অন্যতম উদাহরণ সেনাচিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের চিঠি। তবে বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই?
‘দ্য ফার্স ওয়ার্ল্ড ওয়ার অ্যাডভেঞ্চারস অফ নরিমান কারকারিয়া’। গত বছরই প্রকাশিত হয় এই বিশেষ গ্রন্থটি। যা ভারত তো বটেই, রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল গোটা বিশ্বে। মুরলি রঙ্গনাথনের অনূদিত এই গ্রন্থের মূল লেখক নরিমান কারকারিয়া (Nariman Karkaria) স্বয়ং। কিন্তু কে এই নরিমান কারকারিয়া?
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে বিদেশের মাটিতে রক্ত ঝরিয়েছিলেন যে দশ লক্ষ ভারতীয়, তাঁদেরই একজন নরিমান। যিনি শুধু একটি নয়, ব্রিটেনের হয়ে তিন-তিনটি ফ্রন্টে লড়াই করেছিলেন বিশ্বযুদ্ধে। এবং যুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকেই ডায়েরিতে নথিভুক্ত করেছিলেন নিজের এই আশ্চর্য অভিজ্ঞতার কথা। লিখে রেখেছিলেন এই পাশবিক হানাহানির বিবরণ।
গুজরাটের এক পার্সি পরিবারে জন্ম নরিমানের। ছোটো থেকেই ‘দস্যি’ হিসাবে দুর্নাম ছিল তাঁর। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় কিশোর নরিমান হামেশাই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতেন কাউকে না জানিয়ে। ঘুরতে ঘুরতে হাজির হতেন অজানা জায়গায়। তবে এই দস্যিপনা চলেনি খুব বেশিদিন।
তখন বছর ১২ বয়স। গুজরাট ছেড়ে তাঁকে পাড়ি দিতে হল মুম্বাই। সেখানে বছর দুয়েক থাকা। প্রশিক্ষণ নেওয়া পার্সি পূজারীর। তবে সেই কাজে মন টিকল না বেশিদিন। এদিকে বাড়ি ফিরলে ফের এই একঘেয়ে জীবনেই তাঁকে থাকতে বাধ্য করবে পরিবার। ফলে, সামান্য যা টাকা-কড়ি জমানো ছিল, তা থেকেই টিকিট কেটে ফেললেন হংকং-এর। বোম্বাই বন্দর থেকে জাহাজে চেপে দেশ ছাড়লেন ১৫ বছর বয়সি কারকরিয়া।
সে-সময় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে পাশ্চাত্যে। বিশ্বজুড়ে বদলে যাচ্ছে প্রথাগত নিয়ম-কানুন। ব্রিটিশ অধ্যুষিত হংকং-এর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ছিল একইরকম। বিশ্বযুদ্ধে বহিরাগতদের আটকাতে নয়ানিয়ম জারি করেছিল ব্রিটেন। ফলে, হংকং-এ পৌঁছেও কাজের নাগাল পেলেন না তিনি। এরপর মঙ্গোলিয়া, সাইবেরিয়া, স্ক্যান্ডিনেভিয়া ঘুরে ব্রিটেনে পৌঁছান নরিমান। সেখানে তখন পুরোদমে চলছে সেনানিয়োগের প্রক্রিয়া। খাতায় নাম লেখালেন তিনি। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ায় জুটে গেছিল চাকরিও। ২৪তম মিডলসেক্স রেজিমেন্ট।
১৯১৬, ’১৭, ’১৮— পর পর তিন বছর তিনটি ঐতিহাসিক যুদ্ধে পৃথক পৃথক স্থানে লড়েছিলেন কারকারিয়া। যার প্রথমটি হল সোমের যুদ্ধ বা ‘ব্যাটল অফ সোম’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ও ভয়াবহ এই যুদ্ধে নরিমানের দায়িত্ব ছিল পরিখা রক্ষার। তবে জার্মান সেনাদের অহরহ মেশিনগানের গুলিতে আহত হন নরিমান। বেশ কয়েকমাস অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ীও ছিলেন সে-সময়। তারপর সেরে উঠেই ফের যুদ্ধক্ষেত্র অভিযান। তবে এবার আর পশ্চিম ফ্রন্ট নয়, বরং তাঁকে লড়তে পাঠানো হয়েছিল মিশরে। সেখানে তুরস্কের অটোমান শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন নরিমান। লড়তে লড়তে পৌঁছে গিয়েছিলেন জেরুজালেমে।
তবে খুব একটা সুখকর ছিল না এই অভিযানও। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সে-বারও দীর্ঘ এক মাস শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাঁকে। এরপরের বছর অর্থাৎ ১৯১৮ সালে তাঁর ফিরে যাওয়া বলকান ফ্রন্টে। সালোনিকার যুদ্ধে মেজর পদ নিয়ে লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি।
সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ঘুরে বেড়ানোর এই আশ্চর্য সব অভিজ্ঞতা ডায়েরিতে লিখে রাখতে শুরু করেন নরিমান। না, চিঠির ফর্মে নয়। বরং, তাঁর লেখা ডায়েরি পড়লে মনে হবে, সেই শুরু থেকেই যেন গ্রন্থ নির্মাণের কোনো পরিকল্পনা ছিল তাঁর। আর সেই কারণেই এভাবে পরিপার্শ্বের পুঙ্খানুপুঙ্খ নোট নিয়েছিলেন তিনি। অবশ্য শুধু যুদ্ধের অভিজ্ঞতাই নয়, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় নরিমানের কলমে ধরা পড়েছিল স্থানীয় মানুষদের জীবনযাপন, দারিদ্র, যন্ত্রণার ছবি, তাঁদের সংকট, আর্তনাদের কথা। তাছাড়া অবসর সময়ে জেরুজালেম কিংবা প্যালেস্তাইনের পথে পথে ঘুরে ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থাপত্যের বর্ণনাও নথিভুক্ত করেন তিনি। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যকেও অক্ষরবন্দি করেছিলেন তিনি।
সবমিলিয়ে তাঁর এই গ্রন্থ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এক ভারতীয় সেনানীর জবানি হয়েও যেন হয়ে উঠেছিল সার্বজনীন। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর আজারবাইজানে আশ্রয় নেন নরিমান। কয়েকবছর সেখানে থেকে ফিরেছিলেন দেশে। ১৯২২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল মারাঠি ভাষায় লেখা তাঁর ডায়েরি। অবশ্য সে-যুগে এই গ্রন্থের জন্য খুব একটা নামডাক হয়নি তাঁর। পাঠকমহলে খুব একটা জনপ্রিয়তাও পাননি তিনি। অথচ দেখতে গেলে, এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সেনার লেখা একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জবানি এটিই। যিনি যুদ্ধ শেষের পর বেঁচে ফিরেছিলেন দেশে। জানিয়েছিলেন যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর প্রতিক্রিয়া। বলাই বাহুল্য জীবদ্দশায় জনপ্রিয়তা না পেলেও, একশো বছর পর এই ডায়েরির অনুবাদ নতুন করে জনপ্রিয় করে তুলেছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লড়া ভারতের বীর সেনার কাহিনি। বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ইতিহাসের স্বল্পচর্চিত একটি অধ্যায়ের প্রসঙ্গও…
Powered by Froala Editor