ত্বকের দৃঢ়তা বজায় রাখতে লোশন, সিরাম সহ বহু সাজসজ্জার উপাদান প্যাকেটজাত কিংবা কৌটোজাত হয়ে কোলাজেন ঢুকে পড়েছে ঘরে ঘরে, অন্দরমহলে। আর সেই সূত্রে কোলাজেনের নাম সাম্প্রতিককালে প্রায় কারোরই অজানা নয়। যদিও, ত্বকের উপর কোলাজেনের (Collagen) সরাসরি প্রয়োগের কার্যকারিতা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। কিন্তু এই কোলাজেন কী এবং কোলাজেনের গঠন আবিষ্কারের নেপথ্যে যে রয়েছে ভারতীয় এক বিজ্ঞানীর অসামান্য অবদান, তা বোধহয় জানেন না অনেকেই।
আমাদের শরীরের সমগ্রভাগ প্রোটিনের প্রায় এক চতুর্থাংশই এই কোলাজেন নামক তন্তু দ্বারা গঠিত যা ত্বক, অস্থি, তরুণাস্থি, লিগামেন্ট ও বিভিন্ন যোগকলার (connective tissue) উপাদান হিসাবে উপস্থিত থেকে সেইসব অংশে দৃঢ়তা প্রদান করে।
১৯৫৪ সালে এই কোলাজেনের ত্রিমাত্রিক ট্রিপল হেলিক্যাল গঠন প্রায় সঠিকভাবে অনুমান করেন মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত দুই বিজ্ঞানী রামাচন্দ্রন (Ramachandran) এবং কার্থা, (যা এক্স-রে ডিফ্র্যাকসন পদ্ধতিতে প্রাপ্ত ছবির সাথে বহুলাংশে মেলে)। কিছুকাল পর ১৯৫৫ সালে, ওঁরাই এই মডেলের সামান্য পরিবর্তিত এবং আরও যথাযথ রূপ পেশ করেন। মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণালব্ধ এই ফলাফল প্রকাশিত হয় 'নেচার' জার্নালে, যা আলোড়ন ফেলে দেয় বিশ্বের তাবড় মলিকিউলার বায়োলজিস্ট, বায়োফিজিসিস্টদের (জৈবপদার্থবিজ্ঞানীদের) মধ্যে। তাদের প্রস্তাবিত মডেলটি 'মাদ্রাজ ট্রিপল হেলিক্স' নামে পরিচিত হতে থাকে আন্তর্জাতিক মহলে এবং তারা 'মাদ্রাজ গ্রুপ' নামে।
গোপালসুন্দরম নারায়ণ রামাচন্দ্রনের জন্ম ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে, ইংরেজ অধীনস্থ কেরালার এর্নাকুলামে। এই জন্মশতবর্ষে আসুন আমরা জেনে নিই, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী রামাচন্দ্রন এবং তার কোলাজেনের গঠন আবিষ্কার সম্পর্কিত কিছু কথা।
কোলাজেনের এই মডেলকে বুঝতে গেলে ভেবে নিতে হবে সমান্তরালভাবে থাকা তিনটি টেলিফোনের তারের কথা। এই তিনটি তার একে অপরের সঙ্গে ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে দড়ির মতো পেঁচিয়ে তৈরি করে ট্রিপল হেলিক্যাল 'কুণ্ডলিত-কুণ্ডলী গঠন' (কয়েলড কয়েল স্ট্রাকচার), যার মূল উপাদান হল অ্যামিনো অ্যাসিড গ্লাইসিন এবং ইমিনো অ্যাসিড প্রোলিন ও হাইড্রক্সিপ্রোলিন। এই কোলাজেন তন্তুগুলি একে অপরের সঙ্গে বিশেষ ধরনের সমযোজী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে প্রসার্য ক্ষমতা/স্থিতিস্থাপকতা বাড়িয়ে তোলে। শরীরের স্বাভাবিক নিয়মেই, ক্রমবর্ধমান বয়সের সঙ্গে কোলাজেন উৎপাদন কমতে থাকে এবং কোলাজেন তন্তুর মধ্যস্থ এই ক্রস-লিঙ্কগুলি বেড়ে যেতে থাকে। সেই কারণেই, বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ত্বক, রক্তজালক সহ যোগকলাগুলির স্থিতিস্থাপকতা হ্রাস পেতে থাকে।
রামাচন্দ্রন বলেন, ওই কুণ্ডলিত কুণ্ডলী গঠনের ধারণা ওঁর মাথায় আসে নিজ অক্ষে আবর্তনরত পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের প্রদক্ষিণের ঘটনাটির ভাবনা থেকে। এখানে তেমনি, নিজেরা পাক খেতে থাকা তিনটি তন্তু আবার পরস্পরের সঙ্গে পাক খেয়ে বা কুণ্ডলী পাকিয়ে উল্লিখিত গঠন তৈরি করে।
পাঠ্যপুস্তকে আমরা পড়েছি, ভিটামিন সি-এর ঘাটতিজনিত কারণে স্কার্ভি রোগ হয়। আদতে এই ভিটামিন সি সাহায্য করে কোলাজেন তন্তুর উল্লিখিত উপাদান হাইড্রক্সিপ্রোলিনের কার্যকারিতা বজায় রাখতে, যার অভাবে সদ্য গঠিত কোলাজেন তন্তুগুলির গঠনে সমস্যা দেখা দেয়। এই কারণে প্রয়োজন পর্যাপ্ত পরিমাণে ফল ও শাকসবজি খাওয়া।
দুঃখের বিষয়, পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের বহু আবিষ্কারই স্বীকৃতি পায়নি, পরিবর্তে সে স্বীকৃতির দাবিদার হয়েছেন অন্য কেউ। সেরকমই ঘটনার এক অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকবে এটি।
ডিএনএ-এর ডাবল হেলিক্স গঠনের প্রস্তাবক ফ্রান্সিস ক্রিক ১৯৫৫ সালে ‘নেচার’ জার্নালে লেখেন যে রামাচন্দ্রন এবং কার্থা উল্লিখিত মডেলটি অনেকাংশে ঠিক হলেও প্রস্তাবিত গঠনটি পুরোপুরি সঠিক ছিল না। ক্রিক ও তার সঙ্গে কার্যরত পোস্টডক্টরাল ছাত্র এবং কিংস কলেজের আরেকটি গ্রুপ পূর্বপ্রকাশিত মডেলটির সামান্য পরিবর্তন করেই জার্নালে প্রকাশ করেন। পরিশেষে দেখা যায়, কোলাজেনের এই গঠনের রূপকার হিসাবে বিভিন্ন জায়গায় ফ্রান্সিস ক্রিক ও লাইনাস পলিং-ই পরিচিতি পান।
এতে দমবার পাত্র নন রামাচন্দ্রন। তিনি প্রোটিনের গঠন নিয়ে বিশ্লেষণ করতে বসে এমন একটি কাজ করেন যা প্রোটিন এবং স্ট্রাকচারাল বায়োলজি নিয়ে গবেষণায় বিশেষ ভাবে কার্যকরী হয়ে থাকবে ভবিষ্যতেও। সমগ্র বিশ্বে এটি 'রামাচন্দ্রন প্লট' বা 'ফাই-সাই প্লট' নামে পরিচিত। জীববিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার সঙ্গে যুক্ত সকলেই আজ জানেন রামাচন্দ্রন প্লটের কথা, যা ছাড়া প্রোটিনের গঠনগত গবেষণার কাজ সত্যিই কষ্টসাধ্য ছিল।
রামাচন্দ্রন বহু ছাত্রছাত্রীকে বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহিত করেন। এই ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বায়োফিজিকসের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের কাজের ছাপ রেখে গেছেন পরবর্তীতে। গবেষণার কাজকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি ও আইআইএসসি ব্যাঙ্গালোরে চালু করেন মলিকিউলার বায়োফিজিকস বিভাগ। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা, সঙ্গীতানুরাগী। ফিলোসফি নিয়ে ছিল প্রবল আগ্রহ। আবার কবিতাও লিখেছেন বিজ্ঞান, ধর্ম এবং অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক। বহুবার তিনি তাঁর পুরস্কারের অর্থ দান করে দিয়েছেন বিভিন্ন জায়গায় এবং তা অবশ্যই নিজের নাম গোপন রেখে। রামাচন্দ্রনের মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে মাদ্রাজের সেন্ট্রাল লেদার রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাদের একটি অডিটোরিয়ামের নাম রাখেন 'ট্রিপল হেলিক্স' অডিটোরিয়াম।
'আজি হতে শতবর্ষ পরে'ও এভাবেই ভবিষ্যত প্রজন্মের কোনো স্ট্রাকচারাল বায়োলজিস্ট প্রোচেক বা হোয়াটচেকের মতো সফটওয়্যারে কোনো এক ম্যাক্রোমলিকিউলের গঠনের বৈধতা বুঝে নিতে খুলে বসবে রামাচন্দ্রন প্লট। আর এভাবেই থেকে যাবেন রামাচন্দ্রন, আমাদের মাঝে ও কাজে।
Powered by Froala Editor