মানুষ প্রাণ রক্ষা করতে মিথ্যা কথা বলেন অনেক সময়েই। কিন্তু যেখানে সত্যি পরিচয় দিলেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব, সেখানে মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করতে কজনই বা পারেন? এমনই এক আশ্চর্য যুবক ছিলেন এম মাধবন (M. Madhaban)। মালাবার উপকূলের এই যুবককে হত্যা করেছিল নাৎসি বাহিনী (Nazi Force)। শেষ মুহূর্তেও যদি তিনি জানাতেন যে তিনি একজন ভারতীয়, তাহলে নিশ্চই মুক্তি পেতেন। কিন্তু তাহলে তাঁর ফরাসি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হত। তাই শেষ পর্যন্ত মৃত্যুকেই স্বীকার করে নিয়েছিলেন তিনি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ৭৫ বছর পেরিয়ে এসে ভারতীয়রা আর মনে রাখেননি তাঁকে। শুধু তাঁর জন্মস্থানের কাছে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে একটিমাত্র মূর্তি।
১৯১৪ সালে তৎকালীন ফরাসি উপনিবেশ মাহেতে জন্মগ্রহণ করেন মাধবন। দলিত পরিবারের সন্তান মাধবন। তবে পড়াশোনায় বেশ মেধাবী ছিলেন। আর সামাজিকভাবে নানা বৈষম্যের শিকার হলেও ফরাসি সরকারের স্কুলগুলিতে জাতিভেদকে প্রশ্রয় দেওয়া হত না। পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন মাধবন। সেই শান্তশিষ্ট যুবকটিই বদলে গেলেন ১৯৩৪ সালে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০ বছর। সেই বছর মাহেতে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধী। দলিত উন্নয়নের প্রসঙ্গে তাঁর বক্তৃতা মন ছুঁয়ে গিয়েছিল মাধবনের। এরপর গান্ধীবাদী ইয়ুথ লিগের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন মাধবন। তবে কয়েক মাসের মধ্যেই উচ্চশিক্ষার জন্য পন্ডিচেরী চলে যেতে হয় তাঁকে। সেখানেও হরিজন সেবক সংঘের সদস্য হন তিনি। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খোদ গান্ধীজিই।
দেখতে দেখতে পন্ডিচেরীর পড়াশোনা শেষ হল। সেই সময় ফরাসি উপনিবেশগুলিতে নিয়ম ছিল, এদেশের মেধাবী পড়ুয়াদের নিয়ে যাওয়া হত প্যারিসের সরবন ইউনিভার্সিটিতে। পড়াশোনার খরচ বহন করত ফরাসি সরকারই। ১৯৩৭ সালে সেভাবেই প্যারিস যাওয়ার সুযোগ পেলেন মাধবন। প্রথম কয়েক বছর পড়াশোনা চলছিল ভালোই। সেইসঙ্গে পশ্চিম ইউরোপের নতুন নতুন ধারার রাজনীতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ঠিক এই সময়েই ইউরোপের ভাগ্যাকাশে দুর্যোগ ঘনিয়ে উঠল। একটার পর একটা দেশ দখল করে নাৎসি বাহিনী ক্রমশ এগিয়ে আসছে ফ্রান্সের দিকে। ফ্রান্সের ভিতরে নাৎসি গুপ্তসেনা ঢুকে পড়েছে আগেই। এই সময় ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নাৎসি প্রতিরোধের কাজে নেমে পড়েছিলেন মাধবন। কয়েকজন সদস্যের পরিকল্পনায় একটি নাৎসি গুপ্তসেনা ঘাঁটিতে আক্রমণ চালানো হয়। সেই বাহিনীতেও ছিলেন মাধবন।
তবে এর পরেই জার্মান স্পেশাল ফোর্সের হাতে ধরা পড়েছিলেন মাধবন। ভারতীয় হিসাবে নয়, ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির একজন সদস্য হিসাবেই। আর এরপরেই, ১৯৪২ সালে প্যারিস শহর দখল করে নেয় নাৎসি বাহিনী। গুপ্তসেনা ঘাঁটিতে হামলা চালানোর অপরাধে বন্দি ৫০ জন কমিউনিস্ট সদস্যকে গেস্টাপোর হাতে তুলে দেয় স্পেশাল ফোর্স। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ফোর্ট মন্ট-ভ্যালেরিয়নে। সেখানে প্রথমে শুরু হয় অকথ্য অত্যাচার। মাধবনের চেহারা দেখেই প্রথমে সন্দেহ হয়েছিল জার্মান সেনাদের। তিনি যে আসলে ভারতীয়, এই কথাটাই বের করতে চাইছিলেন বারবার। তবু মাধবন বারবার বলে গিয়েছেন, তিনি একজন ফরাসি। শুধু তাই নয়, নিজেকে ইহুদি বলেও পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
৪০ হাজার ইহুদির প্রাণ বাঁচিয়ে হলোকাস্ট-হিরো জাপানের সুগিহারা
তাঁর সম্পর্কে এর থেকে বেশি কোনো তথ্যই জানা যায় না। এটুকুর উৎসও তাঁর সঙ্গে বন্দি কয়েকজন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যের ডায়রি। পরবর্তীকালে রাশিয়ার গবেষকরা যা উদ্ধার করেছিলেন। এই ডায়রিগুলি থেকেই জানা যায়, এক ফরাসি যুবতীর সঙ্গে প্রেম হয়েছিল মাধবনের। দুজনে বিয়ের পরিকল্পনাও করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই নাৎসি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে গেলেন তাঁরা। ২ বছর ধরে অত্যাচার চলার পর ১৯৪৪ সালে এল সেই দিন। ৪৫ জন কমরেডের সঙ্গে হাত-পা বেঁধে দাঁড় করানো হল মাধবনকে। ঝাঁকে ঝাঁকে ধেয়ে এল ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলি। বন্দি কয়েকজনের ডায়রি থেকে জানা যায়, সেই মুহূর্তে বন্দিরা প্রায় প্রত্যেকেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন। একমাত্র মাধবন তখনও চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিলেন নাৎসি সেনাদের দিকে। আর তাঁর সেই প্রেমিকা? জানা গিয়েছে এর আগেই অসউইৎজ ক্যাম্পে গ্যাস চেম্বারে ফেলে হত্যা করা হয়েছে তাঁকেও।
আরও পড়ুন
‘সন্তানকে শিক্ষিত সাইকোপ্যাথ বানাবেন না’, আর্জি হলোকাস্ট-ফেরত শিক্ষকের
সম্ভবত ইউরোপের হলোকাস্টে নিহত একমাত্র ভারতীয় এম মাধবন। অথচ ইউরোপের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখেনি। মনে রাখেনি ভারতের ইতিহাসও। তবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আজকের পৃথিবীতে তিনি সত্যিই একজন আদর্শ হয়ে ওঠার যোগ্যতা রাখেন, এটুকু নিঃসংশয়ে বলা যায়।
আরও পড়ুন
৭৭ বছর পর উদ্ধার হলোকাস্টের দুই অজানা শিশুর পরিচয়
তথ্যসূত্রঃ Why This Forgotten Indian Hero Was Executed by The Nazis In Their Concentration Camp, Rinchen Norbu Wangchuk, The Better India
Powered by Froala Editor