আয়তনের মানুষের থেকেও বড়ো। প্রায় ৩০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া এক প্রাগৈতিহাসিক মাংসাশী পাখি যদি এসে হাজির হয় আজকের সময়ে? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘বৃহচ্চঞ্চু’ গল্পটির কথাই বলছি। এবার বইয়ের পাতা থেকেই ‘চঞ্চু’-কে সিনেমার পর্দায় তুলে আনলেন পরিচালক আবীর রায়।
তবে কল্পবিজ্ঞানের গল্প যতটা আকর্ষণীয়, ঠিক ততটাই কঠিন বাস্তবায়িত করা তার সিনেমার রূপ। সেই কাজটাই অসাধারণ মুন্সিয়ানার সঙ্গে করেছেন পরিচালক। ৫০ মিনিটের আবহ জুড়ে নেই কোনো আড়ম্বর। ছিমছাম দৃশ্যপট আর সাবলীল গল্প বলার ধরণ দিয়েই মায়াজাল বুনেছেন আবীর। ভিএফএক্সের ব্যবহার হলেও, তাতে আতিশয্য নেই কোথাও।
“আমরা কোনোরকম মনিটাইজ করিনি। কোনো বিজ্ঞাপনও যাতে না আসে সেইদিকটা দেখা হয়েছে। মানুষ যাতে বিনামূল্যে ছবিটি দেখতে পারে, সেই কথাটাই মাথায় রাখা হয়েছে”, বলছিলেন পরিচালক। গত ১৪ মার্চ প্রকাশিত হয় ‘চঞ্চু’। না, কোনো সিনেমা হল নয়, কোনো ওটিটি প্ল্যাটফর্মও নয়। প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ইউটিউবকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। গল্পের স্বত্বের কারণেই এই ছবি থেকে যে আয় করা যাবে না, তা জেনেও তিনি ঝাঁপ দিয়েছিলেন এই কর্মযজ্ঞে। লক্ষ্য ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমাকে একটা জায়গা করে দেওয়া।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ন্যূনতম বাজেট নিয়ে কীভাবে বাস্তবায়ন হল এমন একটি সম্পূর্ণ ছবি? উত্তর দিলেন পরিচালকই। “আসলে অভিনেতারা কেউ-ই পেড নন। সকলেই ইউনিট মেম্বার। যেমন ধরুন সহ-প্রযোজক একটি রোল করেছেন, প্রোডাকশনের অনেকে অভিনয় করেছেন। আর যেহেতু নিজেরাই ভিএফএক্সের কাজ করেছি আমরা, সেই খরচও হয়েছে সামান্য। আউটডোর শুটিং আর অন্যান্য কিছু ক্ষেত্রে খরচ হলেও, সেটার হিসাব নেই কারোর কাছেই।”
কথায় কথায় উঠে এল সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষে প্রকাশিত হলেও, প্রায় দেড় বছর আগে কাজ শুরু হয়েছিল ‘চঞ্চু’ নিয়ে। অথচ প্রকাশ পাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্তও সেইভাবে কোনো প্রচার হয়নি ছবিটির। কেবল একটিমাত্র পোস্টার নিজের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশ করেছিলেন পরিচালক। তা সত্ত্বেও দর্শকমহলে নিজের জায়গা করে নিতে পারছে ‘চঞ্চু’। সেখানেই বোধহয় ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমার জিত। পরিচালকের মুখেও উঠে এল সেই কথাই, “শুধু চঞ্চুই নয়, মানুষ ইন্ডিপেন্ডন্ট সিনেমার প্রতি এত সময় দিচ্ছেন, সেটার জন্য আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। গত দেড় বছর ধরে বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি প্রায় বসে গেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্মে যে ভালো কাজ হচ্ছে না, তা নয়। তবে কিছু জায়গায় থ্রিলার থাকলেও গল্পের বাঁধন পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই আমরা যারা মূলত গল্প বলতে চাইছি, তাঁরা অনেকটা জোর পেলাম।”
সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে মাস কমিউনিকেশন এবং ভিডিওগ্রাফিতে স্নাতক আবীর রায়। তারপর ঢুকে পড়া চলচ্চিত্রের জগতে। কিন্তু কাজের অনিশ্চয়তা জন্যই বিকল্প পথের অনুসন্ধানে হেঁটেছিলেন তিনি। তবে বর্তমানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ক্ষেত্রে চাকরি করলেও সিনেমার সঙ্গে সম্পর্কে ছেদ পড়েনি এতটুকু। নিজের কাজ সামলেই বাকি অবসর সময়টুকু তিনি নিংড়ে দিচ্ছেন শিল্পসৃষ্টিতে।
এর আগেও দর্শকমহলে সাড়া ফেলেছিল আবীর রায়ের তৈরি ‘স্বপ্নের নাম মেসি’ কিংবা ‘চলমান অশরীরী’-র মতো ছবি। ‘চঞ্চু’-র ক্ষেত্রেও অন্যথা হল না তার। আগাম সিনেমার খবর জানতে চাওয়ায় সুখবর দিলেন আবীরবাবু, “এটা একটু বড়ো বাজেটের। মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে বর্তমানে একটা কাজ চলছে। টেলিভিশনে যেমন অনুষ্ঠান আমরা দেখে থাকি, তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। নৃত্যনাট্যকে বাদ দিয়ে বাস্তবসম্মতভাবে মহিষাসুরমর্দিনীর গল্পটা দেখানোর চেষ্টা করেছি। ভিএফএক্সের কাজও থাকবে সেখানে।” পুজোর আগে মহালয়াতেই আসতে চলেছে এই সিনেমা। অপেক্ষা আর মাত্র কয়েক মাসের। ‘চঞ্চু’-র পর আরও একটি ভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র উপহার দিতে চলেছেন পরিচালক, সে-আশা রাখাই যায়!
Powered by Froala Editor