“মিষ্টি আমাদের বাংলার একটি বড়ো হেরিটেজ। বাঁকুড়ার পোড়ামন্দির বা তাঁতের সাড়ি যেমন ঐতিহ্য, তেমন মিষ্টিও। একশো, দেড়শোরও বেশি মিষ্টি ছিল কিন্তু এখন সেটা এসে ঠেকেছে মাত্র পঁচিশ থেকে তিরিশে। বাকি মিষ্টির কারিগর, রেসিপি, ক্রেতা-বিক্রেতাও হারিয়ে গেছে। পুরনো বই হলেই যেমন তাকে ফেলে দিতে হবে এমন নয়, তেমনই পুরনো অনেক মিষ্টি আছে সেগুলোকে আমরা হারিয়ে দিতে পারি না। তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
বলছিলেন অর্থনীতিবিদ রবীন ঘোষ। টেলিভিশন প্রোডিউসার অ্যাসোসিয়েশন অফ কলকাতার সেক্রেটরির দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘ইনফোকম’-এর দৌলতেই মাত্রা পেয়েছে টেলিভিশন সফটওয়্যার। স্ক্রিপ্ট রাইটিং, শুটিং, এডিটিং— গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গেই জুড়ে ছিলেন তিনি। ইকোনমিস্ট হিসাবে কাজ করেছেন মহারাষ্ট্র এবং ভারত সরকারের হয়েও। তবে এবার এক ভিন্ন উদ্যোগ নিয়েই পথে নেমেছেন তিনি। বাংলার বুক থেকে হারিয়ে যাওয়া মিষ্টিদের নতুন করে ফিরিয়ে আনতেই নিয়েছেন এক বিশাল কর্মসূচি।
শান্তিনিকেতন সোসাইটি অফ ইউথ এমপাওয়ারমেন্ট। ১৪-১৫ বছর আগে শান্তিনিকেতনে এই অলাভজনক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ছাত্র রবীনবাবু। লক্ষ্য তরুণ প্রজন্ম যাতে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। বিগত কয়েক বছরে প্রায় চার-পাঁচ হাজার তরুণ-তরুণীকে নানা ধরণের ট্রেনিং দিয়েছে এই সংস্থা। আর সেই সংস্থার উদ্যোগে শান্তিনিকেতনেই চালু হয়েছিল ‘মিষ্টি অ্যাকাডেমি’। কলকাতাতেও খুলতে চলেছে তার শাখা। কিন্তু কী এই মিষ্টি ‘অ্যাকাডেমি’?
জানালেন স্বয়ং রবীনবাবুই, “বিশেষ করে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ওপরেই জোর দিতে চাই। আমরা ইতিমধ্যেই কুড়িজন মহিলাকে ট্রেনিং দিয়েছি মিষ্টি তৈরির। কারণ যে কোনো অনুষ্ঠানেই মিষ্টির চাহিদা থাকে। কোথাও একশোটা আবার কোথাও পঞ্চাশটা। সেটা সবসময় দোকানে পাওয়া যায় না। সেই শূন্যস্থানটা পূরণ করতে পারে একমাত্র স্বনির্ভর গোষ্ঠীই।”
কথায় রবীনবাবু জানালেন, বাংলার মিষ্টির বাজারের পরিধি প্রায় সতেরোশো কোটি টাকা। রয়েছে লক্ষাধিক মিষ্টির দোকান। তবে এত বড়ো একটি বাণিজ্যিক প্ল্যাটফর্ম হওয়া সত্ত্বেও সেখানে সেভাবে কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। “প্রতি বাঙালির বাড়িতেই মিষ্টি সপ্তাহে অন্তত একবার ঢোকেই। কিন্তু এই ইন্ডাস্ট্রিটা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর, অনুপযুক্ত এবং অগোছালো। সেভাবে কোনো রিটেল চেনের কথাই ভাবা হয়নি এই ক্ষেত্রে। গোটা ভারতে যে বাংলা মিষ্টি বিক্রি হয়, তা বাংলা মিষ্টিই নয়। বর্তমানে বড়ো বড়ো মিষ্টির দোকানে যেসব মিষ্টি পাওয়া যায়, সেগুলো সবই ডাইলুটেড হয়ে যায়। তা অরিজিনাল ফর্ম না। পাশাপাশি অনেক জায়গাতেই চার-পাঁচ ধরণের মিষ্টির বাইরে আর কোনো মিষ্টি রাখে না। এই গোটা ইন্ডাস্ট্রিটার আধুনিকরণের দরকার আছে”, বলছিলেন রবীনবাবু।
কিন্তু কীভাবে সম্ভব এই বিবর্তন? বিস্তারিত বর্ণনা দিলেন রবীনবাবু, “বর্তমানে মিষ্টি তৈরির অনেক যন্ত্র এসেছে বাজারে। রসগোল্লা তৈরির যন্ত্র রয়েছে, যাতে আরও ছ’টা মিষ্টি তৈরি হয়। এবং একই আয়তনের, একই স্বাদের মিষ্টি তৈরি সম্ভব এর মাধ্যমে। খোয়া বা রাবড়ির ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু সাধারণ ময়রার দোকানের কারিগরদের দিয়ে এই মেশিন চালান যাবে না। কারণ তাতে স্কিলড ম্যান-পাওয়ার লাগে। সেই প্রশিক্ষণের কোনো বন্দোবস্ত নেই ভারতে। অথচ আগামীদিনে এই যন্ত্রগুলি ছাড়া মিষ্টির ব্যবসার পরিধি বিস্তৃত হওয়া সম্ভব নয়।”
বিগত দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি নিয়েই বিস্তারিত গবেষণা করেছেন তিনি। তলিয়ে দেখেছেন তার ইতিহাস, বাণিজ্যের ক্ষেত্রও। কিন্তু এর মধ্যেও তো বাকি থেকে যায় অনেক কিছুই। সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্যও হারিয়ে যাওয়া মিষ্টি তৈরির প্রতিযোগিতাও আয়োজন করেছিলেন তিনি। অনলাইনেই। সেখান থেকেও উঠে এসেছে একাধিক ঐতিহ্যবাহী অবলুপ্ত রন্ধনপ্রণালী। আগামী দিনেও যে এই উদ্যোগ চলবে, সে ব্যাপারে জানালেন রবীনবাবু।
আর বাণিজ্যিক প্রেক্ষাপট? স্বনির্ভরতা? সেটাও তো অন্যতম একটি লক্ষ্য এই উদ্যোগের। সেটা কীভাবে পূরণ করছে ‘মিষ্টি অ্যাকাডেমি’? পারতপক্ষে গোটাটাই একটি অব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তবে সংস্থা থেকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের দিয়েই তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন প্রাচীন মিষ্টির প্রণালী। তারপর তা পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে শান্তিনিকেতনের ছোটো ছোটো মিষ্টির দোকানে। অনেকটা ফ্র্যাঞ্চাইজি স্টোর হিসাবেই ভাবতে পারেন। মাইক্রো এন্টারপ্রেনিয়োরগুলি এভাবেই জুড়ে যাচ্ছে গোটা উদ্যোগটার সঙ্গে। উপকৃত হচ্ছে। এসব দোকানে আগে থেকে অর্ডার দিলে যে কোনো হারিয়ে যাওয়া মিষ্টিও পাওয়া যাবে পরিমাণ মতো। কারিগর স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারাই। ছোটো ছোটো এই দোকানগুলির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিষ্টি স্টেশন’।
এখানেই শেষ নয়। তৈরি হয়েছে ‘বাংলা মিষ্টি অনলাইন’ নামে একটি পোর্টালও। সেখানে অর্ডার করলে বাড়িতেই পৌঁছে যাবে মিষ্টি। বাংলায় সেই পরিষেবাও চলছে সমানভাবে। রবীনবাবু জানালেন, “বেশ ভালো সাড়া পাচ্ছি দিল্লি, মুম্বাই এমনকি আমেরিকা থেকেও। অনেকেরই আত্মীয় থাকেন বাংলায়। কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে উপহার হিসাবে এভাবেই মিষ্টি পাঠাচ্ছেন তাঁরা।”
একদিকে যেমন এই উদ্যোগ বৃহত্তর অর্থে সচল করছে বাংলার অর্থনীতিকে, তেমনই সংস্কৃতি রক্ষাতেও যোগাচ্ছে নতুন করে সঞ্জীবনী। প্রণালীর তালিকায় মিলে-মিশে যাচ্ছে দুই বাংলারই বিভিন্ন মিষ্টির পদ। তরুণ প্রজন্মকে মিষ্টিমুখী করতে নেওয়া হচ্ছে অভিনব পন্থা। রাবড়ি দেওয়া হচ্ছে কখনো আইসক্রিমের মতো কোনে। ঐতিহ্য অপরিবর্তিত রেখেই উপস্থাপনার বদল যেন নতুন মাত্রা এনে দিচ্ছে। সংরক্ষণের এর থেকে ভালো উপায় আর কীই বা হতে পারে? সবমিলিয়ে বলতে গেলে তাঁর হাত ধরেই মিষ্টিরজগতে আসতে চলেছে এক ‘রেভোলিউশন’…
Powered by Froala Editor