গরমে ডিহাইড্রেশন এবং তার থেকে ডায়রিয়া হওয়া ছিল তখন অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এমন সময় বাজারে এল একটি শরবত। গাঢ় গোলাপি বা প্রায় লাল রঙের শরবত। যার নাম ‘রুহ আফজা’। বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায়, আত্মবর্ধক। যেমন তেমন শরবত নয়, এ একেবারে গরমের মহৌষধ। তৈরি করেছেন দিল্লিরই এক ইউনানি চিকিৎসক, হাকিম আবদুল মজিদ। যেদিন এই শরবত তিনি তৈরি করলেন, সেদিন রীতিমতো ভিড় জমে গেল তাঁর দাওয়াখানা ‘হামদর্দ’-এর সামনে। শোনা যায় এক ঘণ্টার মধ্যে নাকি ১০০ বোতল সিরাপ বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। সকলেরই যে ডায়রিয়া হয়েছে, এমন নয়। গরমে কি কষ্ট হয় না? আর খোদ হাকিমসাহেব তো বলেই দিয়েছেন, এই ওষুধে কোনো ক্ষতি নেই।
ঠান্ডা একগ্লাস জলে দু-চামচ সিরাপ দিয়ে তৈরি শরবত। এই সিরাপের মধ্যে আছে নানা ধরণের ফলমূল আর জরিবুটি। আর তার সঙ্গে একটুখানি গোলাপজলের গন্ধ। সব মিলিয়ে স্বাদে-গন্ধে একেবারে অতুলনীয়। ওষুধ হিসাবেও কম কার্যকর নয়। সকাল-সন্ধ্যা এক গ্লাস করে শরবত খেয়ে নিলেই গরমের কষ্ট একেবারে লাঘব। এমন একটা ওষুধের জনপ্রিয়তা যে বাড়বেই, তাতে সন্দেহ নেই। দাওয়াখানা ছেড়ে শেষ পর্যন্ত শরবতের কারখানা তৈরিতেই মন দিতে হল হাকিম আবদুল মজিদকে। গাজিয়াবাদের তৈরি হল কারখানা। শরবতের সব উপাদানই গরমকালে পাওয়া যায়। তবে শীতকালেও ‘রুহ আফজা’-র চাহিদা নেহাৎ কম নয়। সিরাপ সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হল। আর এইসব হতে হতেই ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হয়ে উঠল দিল্লি।
একসময় দিল্লির সংজ্ঞা হয়ে উঠল নেহারি, বাদামি পুরি আর রুহ আফজা। প্রত্যেকের ঘরে ঘরে এক বোতল সিরাপ রাখা থাকবেই। দিল্লি শহর তো বটেই, আশেপাশের এলাকাতেও তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। ভারতীয়দের পাশাপাশি সাহেব কর্মচারীদের কাছেও রুহ আফজা হয়ে উঠল অতি জনপ্রিয়। এদেশের গরমে তো তাঁরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন। জনপ্রিয়তা এমন পর্যায়ে পৌঁছোল যে, ৪০-এর দশকে দিল্লির ইফতারের আসর রুহ আফজা ছাড়া কল্পনাই করা যেত না।
এসবের মধ্যেই চলে এল দেশভাগ। ধর্মের ভিত্তিতে তৈরি হল ভারত এবং পাকিস্তান। প্রথম প্রথম অবশ্য হাকিম পরিবার দিল্লি ছেড়ে যেতে চাননি। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হলে পরিস্থিতি বদল হয়। মজিদের বড়ো ছেলে নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে যেতে চাইলেন না কিছুতেই। কিন্তু ছোট ছেলে মনে করলেন পাকিস্তান চলে যাওয়াই ভালো হবে। অতএব রওয়ানা হলেন করাচির পথে। সঙ্গে নিয়ে রুহ আফজার উপাদানের তালিকা। ১৯৪৮ সালে করাচির বুকে তৈরি হল আরেকটি কারখানা। আর সেখানেও জনপ্রিয়তা কম নয়। বিশেষ করে রমজান মাসে ইফতারের আসরে একগ্লাস রুহ আফজার শরবত চাইই চাই।
১৯৭১ সালে আবারও এক দেশভাগ। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি হল বাংলাদেশ। কিন্তু পূর্ব প্রান্তের বাঙালিদের মধ্যেও ততদিনে রুহ আফজার চাহিদা ছড়িয়ে পড়েছে। তাই তাঁদের জন্যও তৈরি করতে হল একটি কারখানা। কিছুদিন আগেই ১১৫ বছর সম্পূর্ণ করল এই সিরাপ। বাজারে এখন নানা ধরণের ব্র্যান্ডেড শরবতের অভাব নেই। কিন্তু রুহ আফজার চাহিদা তাতে একটুও মলিন হয়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা, আজও তার দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যেই। আর সম্পূর্ণটাই তৈরি ভেষজ উপাদান থেকে। এমন প্রাকৃতিক স্বাদ ও গন্ধ আর কোনো সিরাপেই পাওয়া যায় না। দেশ ভেঙে ভেঙে তিনটে টুকরো হয়েছে। কিন্তু সেই ভেঙে যাওয়া দেশকেই ধরে রেখেছে এই সিরাপ। রুহ আফজা। ধরে রেখেছে খানিকটা ইতিহাসও।
Powered by Froala Editor