লাহোর থেকে ছদ্মবেশে কলকাতায়; বিধান সরণির এই বাড়িতেই লুকিয়ে ছিলেন ভগৎ সিং

শ্যামবাজার মোড়ে যেখানে নেতাজির ঘোড়ায় চড়া মূর্তিটা সবার দিকে নজর রাখছে, সেখান থেকেই রাস্তার পাঁচটি মাথা পাঁচ দিকে চলে গেছে। সেখান থেকেই বাঁক নিয়ে একটি মাথায় ঢুকে পড়া গেল। বিধান সরণির ওপর দিয়ে শুরু হল আমাদের পথ চলা। দুই ধারে অনেক ইতিহাসের নজির; কিছু হয়তো জানি, কিছু হয়তো আজও এক কোণে চুপ করে বসে আছে। তাদের মধ্যে দিয়েই গাড়ি হাজির হল ১৯, বিধান সরণি ঠিকানায়। আর্য সমাজ মন্দিরের বিশাল হলুদ বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ধারেই। ভেতরে ঢুকলে কেউ এসে হয়তো নিয়ে যাবে দোতলার বাঁ দিকের একটা ঘরে। বইপত্র রাখা ঘরটা দেখলে আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য হয়তো চোখে পড়বে না। কিন্তু সেখানকার কর্মীরা বলবে এর মাহাত্ম্য। আজ থেকে ৯২ বছর আগে এই ঘরেই যে আত্মগোপন করেছিলেন ভগৎ সিং! আর তারপরই রওনা হয়েছিলেন দিল্লির উদ্দেশ্যে… 

১৯২৮ সাল। ভারতের মাটিতে পা রেখেছে সাইমন কমিশন। আর তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে জনগণ। এই কমিশন কিছুতেই মানবে না ভারতীয়রা। এমনই একটি মিছিল আয়োজন করা হল লাহোরে। মিছিলের সামনের সারিতে ছিলেন পাঞ্জাব তথা ভারতের অন্যতম নেতা লালা লাজপত রায়। শান্তিপূর্ণভাবেই এগোচ্ছিলেন সবাই; হঠাৎই সেখানে চড়াও হয় ব্রিটিশ পুলিশের বাহিনী। নির্মমভাবে লাঠিচার্জ করতে থাকে মিছিলের মানুষগুলোর ওপর। বৃদ্ধ লালা লাজপত রায়কেও ছাড়ল না ব্রিটিশরা। লাঠির আঘাতে গুরুতর আহত হন পাঞ্জাব কেশরী। পরে মারাও যান… 

গোটা পাঞ্জাব স্তব্ধ হয়ে গেল লালা’র মৃত্যুর খবর শুনে। ব্রিটিশ পুলিশের এত বড়ো সাহস! কী ভেবেছে ভারতীয়দের! লালা লাজপত রায়ের মৃত্যুর ‘বদলা’ নিতেই হবে। শপথ নিলেন পাঞ্জাবের বীর সন্তান ভগৎ সিং। বিপ্লবের মন্ত্র তখন তাঁর শিরায় শিরায়। জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্তে-ভেজা মাটি ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছেন, ব্রিটিশদের উৎখাত করবেনই। সেই থেকে লড়াইয়ে নেমেছেন তিনি। ঠিক করলেন, লালা-র হত্যাকারীকে সাজা দেবেন তিনি। তৈরি করেন অপারেশনের নকশা। এরপরই লাহোরে সহকারী পুলিশ সুপার জন স্যান্ডার্স-কে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেন ভগৎ সিং আর সুখদেব। ব্রিটিশদের হাতে এখনই ধরা দেওয়া চলবে না। তাই, শুরু হল আত্মগোপন পর্ব… 

লাহোর স্টেশনে হাজির হয়েছে একটি পরিবার। এক মহিলা, সঙ্গে তাঁর স্বামী ও সন্তান। পেছনে মালপত্র নিয়ে হাজির হয়েছে চাকর। ঠিক করেছেন লখনউ যাবেন। স্টেশনে একটু বেশিই পুলিশ। সাহেবদের কাছে খবর, অফিসার স্যান্ডার্স-কে যে হত্যা করেছে, সে একজন শিখ যুবক, অবিবাহিত। স্বাভাবিকভাবেই পালানোর ছক কষবে বিপ্লবীরা। তাই সমস্ত জায়গায় কড়া পাহারা। তার মধ্যে দিয়েই লখনউগামী ট্রেনে উঠল ওই পরিবার। কেউ জানতেও পারল না, এই পরিবারের ভেতরেই লুকিয়ে আছে আসল রহস্য। আত্মগোপন করার জন্য সবার আগে নিজের চুল-দাড়ি ছাঁটলেন ভগৎ সিং। হিন্দুস্তান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ভগবতী চরণ ভোহরা’র সঙ্গে। তাঁর স্ত্রী দুর্গা দেবী ভোহরা ওরফে দুর্গা ভাবী-ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। স্যান্ডার্স-কে হত্যা করার পর ভগৎ সিং চলে গেলেন তাঁদের কাছে। দুর্গা ভাবী রাজি হলেন ভগৎ সিংকে সাহায্য করতে। 

বুঝতে পারছেন, লাহোর স্টেশনে স্বামী-স্ত্রী’র ছদ্মবেশে সেদিন কে ছিল? হ্যাঁ, ভগৎ সিং আর দুর্গা ভাবী। সঙ্গে ছিল তাঁর ছোট্ট সন্তানও। সবাই মিলে উঠলেন ট্রেনে। লখনউ গিয়ে ট্রেন বদল করেন; গন্তব্য এখন কলকাতা। যাওয়ার আগে কলকাতায় নিজের বান্ধবী সুশীলা দেবীকে টেলিগ্রাম করলেন দুর্গা ভাবী। বললেন, আত্মগোপনে থাকার সমস্ত আয়োজন করে রাখতে। সুশীলা হাজির হলেন তাঁর ছাত্রীর বাবা ছাজুরাম চৌধুরীর কাছে। ভগৎ সিংকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিতে রাজি হলেন ছাজুরাম। কলকাতায় আসার পর তাঁর কাশীপুরের বাড়িতেই ওঠেন ভগৎ সিং। 

কিন্তু এখানেও বড়ো বিপদ। ব্রিটিশ পুলিশ এখানেও বারবার হানা দিচ্ছে। সব জায়গায় তল্লাশি চলছে। তাহলে উপায়? ছাজুরাম চৌধুরী তখন ছিলেন কলকাতার আর্য সমাজের অন্যতম কর্তা। ভগৎ সিংকে নিয়ে গেলেন আর্য সমাজ মন্দিরে। এখানে ব্রিটিশ পুলিশের নজর পড়বে না, তাই এটাই তাঁর পক্ষে নিরাপদ জায়গা। আজকের ১৯, বিধান সরণিতে যে বাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তারই দোতলার একটি ঘরে বেশ কয়েকমাস আত্মগোপন করেছিলেন ভগৎ সিং। অবশ্য এটাই প্রথমবার নয়। এর আগেও কলকাতায় এসে এই আর্য সমাজ মন্দিরেই থেকেছিলেন তিনি। তখন অবশ্য লক্ষ্য ছিল বোমা বানানোর কৌশল শেখা। 

আরও পড়ুন
ঠিকভাবে সংরক্ষণ হয়নি পুরাসামগ্রীর, কলকাতা জাদুঘরের সংস্কার প্রকল্প ঘিরে প্রশ্ন

বেশ কয়েকমাস থাকার পর জীবনের শেষ বিপ্লবী কর্মসূচি পালন করার জন্য রওনা দেন ভগৎ সিং। অন্যদিকে তৈরি হচ্ছেন বটুকেশ্বর দত্তও। দুজনে মিলে দিল্লির পার্লামেন্ট হাউজ কাঁপিয়ে দেবেন। বাড়িটার সামনে দাঁড়ালে কখনও মনে হয় এই কথা? কখনও মনে হয়েছে, একসময় এই বাড়িরই একটি ঘরে শুয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন ভারতের অন্যতম বীর বিপ্লবী। শুধু রয়ে গেছে ইতিহাসের কিছু চিহ্ন। আর রয়ে গেছে এই কাহিনি। আর্য সমাজ মন্দিরে জিজ্ঞেস করলে শুনতে পাবেন সবটা। চাইলে দেখেও আসতে পারেন সেই ঐতিহাসিক ঘর। রাস্তার আওয়াজে, ধুলোর মাঝে একপ্রকার চুপ করেই বসে আছে ইতিহাস। বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার আগে নাকি ভগৎ সিং তাঁর ব্যবহৃত থালা আর লোটা দিয়ে যান মন্দিরের এক প্রহরীকে। আক্ষেপ, তিনি এর গুরুত্ব বোঝেননি। কালের নিয়মে সেসব হারিয়ে গেছে চিরতরে। কিন্তু এই ঘর, এই রোমহর্ষক কাহিনি? আর ভগৎ সিং? বিপ্লব কি কখনও মরে যায়? দিল্লি পার্লামেন্টে বোমা ফাটিয়ে চিৎকার করে সেই বিপ্লবেরই জয়ধ্বনি দিয়েছিলেন তো তিনি— ইনকিলাব জিন্দাবাদ! 

তথ্যসূত্র—
১) ‘Bhagat Singh’s association with Kolkata’s Arya Samaj temple continues’, Shubhadeep Choudhury, The Tribune
২) ‘Who was Durga Bhabhi? The woman who helped Bhagat Singh escape from Lahore to Calcutta’, Madhuri Adnal, One India
৩) ‘Durga Devi: The Revolutionary Who Led Bhagat Singh To Freedom’, Teerna Mandal, Feminism in India
৪) ‘ভরতের আখ্যান এই ভবনে থমকে রয়েছে ৯১ বছর’, রাজা চট্টোপাধ্যায়, এই সময় 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ছাতুবাবুর মাঠে যে খেলা দেখতে ভেঙে পড়ত সারা কলকাতা

More From Author See More