সবুজ খেতের ওপর একমনে চাষ করে যাচ্ছেন কৃষক। একপাশে গরুদের দাঁড় করিয়ে গাছতলায় জিরিয়ে নিচ্ছে কিশোর রাখাল। পুকুরের দাপাদাপি সেরে ঘরে ফিরে গেছে ছেলেরা; তারই মাঝে একতারা হাতে বাউল গান গেয়ে চলেছে। হয়ত দূরে কারোর বাড়ি থেকে পুরনো সেতারের আওয়াজ আসছে। বাংলার প্রতিটা গ্রামে এমনই চিরন্তন ছবি বারবার নানা লেখায় ফুটে উঠেছে। শুধু কি লেখায়? আধুনিকতা আর উন্নয়নের প্রয়োজন তো আছেই; কিন্তু এই সারল্য তো আজও আনাচে কানাচে রয়ে গেছে। হুগলি জেলার উলুবেড়িয়ার ১ নং ব্লকের এই গ্রামটিতেও একইরকম সুর বেজে ওঠে। আপাতভাবে সাধারণ গ্রামই মনে হবে। কিন্তু একটু উঁকি মারলেই জগতটা বদলে যাবে। এই দাদপুর গ্রামেরই ঘরে ঘরে তৈরি হয় এক একটি তারের বাদ্যযন্ত্র। যার খ্যাতি শুধু বাংলাতেই নেই; ছড়িয়ে পড়েছে ভারত এবং বিশ্বের অন্যত্রও…
‘সাধের লাউ বানাইল মোরে বৈরাগী’। ‘লাউ’টি যে কেবল গানেই নয়, বাস্তবেও আছে সেটা দেখতে গেলে একবার আসতেই হবে দাদপুরে। তার আগে একটু ফিরে দেখা যাক অতীতে। অকুস্থল কলকাতার গিরিশ পার্ক। সেখানেই একটি চায়ের দোকানে বসতেন তারাপদ হালদার। সেটাই ছিল জীবিকা। সেখান থেকে রাধাকৃষ্ণ শর্মা অ্যান্ড কোং-এ দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজে ঢোকা। দোকানটি ছিল সেতার তৈরির। সেখান থেকেই শুরু। আর সেটাই নেশায় পরিণত হয়ে গেল। প্রাথমিক কাজটুকু শিখে তারাপদ চলে গেলেন লখনউ। নবাবি জায়গা বলে কথা, শিল্পের কদর সেখানে সবসময়। শুধু সেতার নয়; সমস্ত রকম তারের যন্ত্র তৈরির কারুকার্য শিখে নিলেন তারাপদ। একসময় নিজেই হয়ে উঠলেন প্রতিষ্ঠান।
লখনউতে দীর্ঘ সময় কাটানোর পর নিজের গ্রাম দাদপুরে ফিরে সবাইকে এই তারের শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির কৌশল শেখাতে শুরু করলেন। এর আগে গ্রামে এমন কাজ কেউ করত না। তারাপদ হালদার একাই একটা শিল্প তৈরি করলেন এখানে। সময়টা ষাটের দশকের শেষের দিক। ধীরে ধীরে দাদপুরের নাম ছড়াতে লাগল সব জায়গায়। সেতার, রুদ্রবীণা, মোহনবীণা, তানপুরা থেকে শুরু করে ৪৫ রকমের যন্ত্র তৈরি করতেন সেই সময়! সেই সঙ্গে শুরু হল ‘তুম্ব’-এর চাষ। তুম্ব, অর্থাৎ একপ্রকার বড়ো প্রজাতির লাউয়ের খোল। খাওয়ার জন্য নয়; এই লাউ চাষই করা হয় বাদ্যযন্ত্রের খোল তৈরি করার জন্য। শুধু নিজেরা ব্যবহার করেন তাই নয়, বাইরে বিক্রিও করেন প্রয়োজনমতো।
এখন দাদপুরের প্রতিটা বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়। তারাপদবাবু চলে গেছেন; কিন্তু তাঁর পরিবার এখনও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। বেনারস, মুম্বই, লখনউ তো বটেই; দেশের বাইরে থেকেও অর্ডার আসে। প্রখ্যাত উস্তাদরা অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে নিয়ে যান তাঁদের সাধের যন্ত্র। এক কথায় সরস্বতীর আস্তানা। যেখানে প্রতিমুহূর্তে তৈরি হয় রাগ শৃঙ্গার। আর যে তারে বেজে ওঠেন উস্তাদের ভেতরের ঈশ্বর। হুগলির দাদপুর সেই ঈশ্বরদেরই ধারণ করেন।
আরও পড়ুন
একসময় গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরত, আজ হারিয়ে যেতে বসেছে সাঁওতালি ‘চাদর-বাঁধনী’ পুতুল নাচ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
'এই স্যারটা তো আগে গ্রামে আসেক নাই বটে!' - সত্যজিতের সুরে বুঁদ আদিবাসী শিশুরা