হিউয়েন সাং-এর মন্দির? কলকাতায়? বলিস কী?’
ফোনে কথা হচ্ছিল আমার প্রাক্তন সহপাঠী জেনিফার লিউ-এর সঙ্গে। জেনিফারেরা বহুবছর ধরে বৌবাজারের বাসিন্দা। প্রতিবছর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হল্লা করে বেরিয়ে পড়ে চিনা নতুন বছর পালন করতে। দরজায় কড়া নাড়লেই হাসিমুখে দরজা খুলে দেন গৃহকর্তা। তাঁর হাতে থাকে লাল খাম, আর মিষ্টি। সেই টুকটুকে খামে থাকে অল্প কিছু টাকা। নববর্ষে দরজা থেকে ফিরে যায় না কেউ। সকলে হইহই করে এরপর মন্দিরে যায়। এই কলকাতারই আনাচে কানাচে ছড়িয়ে নানা বৌদ্ধ মন্দির আর স্তুপ। নববর্ষ উপলক্ষে চলে রাতভোর মন্দির দর্শন। তেমনি একটি মন্দিরের কথা বলছিল জেনিফার। রুবি ছাড়িয়ে পশ্চিম চৌবাগায় নাকি রয়েছে হিউএন সাং-এর স্তুপ।
বিকেলের কলকাতা। রুবির মোড় থেকে বেশ অনেকটাই রাস্তা পশ্চিম চৌবাগা। বিশাল জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে বিশাল চিনা মন্দির। তিনতলা মন্দিরের ফটক খুলে দিলেন যিনি, তিনি জন্মসূত্রে চিনা। অথচ মাতৃভাষার একবর্ণও জানেন না। তিনি নিজেই একজন ভিক্ষু। এই মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক। নাম ‘লিয়েন মিন’ অথবা ‘অচ্ছু’। তাঁর মুখ থেকে জানতে পারলাম যে, এই মন্দিরটির বয়সও নয় নয় করে ৬৬ পেরোল। সেই ১৯৬৪ সালে চিনা ভিক্ষু ‘য়ু শিয়ান’ স্থাপন করেন এই মন্দির অথবা মঠ। ঘটনাচক্রে তিনি ছিলেন লিয়েন মিনের গুরু...
৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে পরিব্রাজক হিউয়েন সাং বা শুয়াংজাং পা রাখলেন নালন্দায়। তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন নালন্দার অধ্যক্ষ শীলভদ্র। সেখানে দু'বছরে তিনি অধ্যয়ন করলেন ন্যায় ও বৌদ্ধ দর্শন। এর দশবছর আগে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রাটি শুরু হয়েছিল তাঁর। বুদ্ধের পদচিহ্ন ধরে ঘুরেছেন ভারত। দেশে ফিরলেন প্রায় ৬৫৭টি সংস্কৃত পুঁথি নিয়ে। যার মধ্যে ছিল নাগার্জুন রচিত ‘মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রে’র তিনটি বিশাল পুঁথি। ৬৬০ খ্রিস্টাব্দে তা অনূদিত হল চিনা ভাষায়। শুয়াংজাং তাঁর শিষ্যদের সাহায্যে সেই দুরূহ পুঁথি অনুবাদ করেছিলেন। যার ফলে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার পূর্ব এশিয়ার আরো সহজ হয়ে পড়ল। শুয়াংজাং-এর মৃত্যুর প্রায় ৯০০ বছর পর লেখা হয়েছিল মিং বংশের রাজত্বকালে লেখা হয়েছিল বিখ্যাত চিনা উপন্যাস ‘পশ্চিমে যাত্রা’ (শি ইউ জি)। ইতিহাস-রূপকথার মিশেলে, দৈত্য-দানব-রাক্ষসে ভরা এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র ছিলেন বুদ্ধের অবতার শুয়াংজাং। বলা বাহুল্য, তা সৃষ্টি হিউয়েন সাং-এরই আদলে...
মন্দিরের ভেতরে বৌদ্ধস্তূপ। সোনালি আলোয় বরাভয় দেখান শুয়াংজাং। কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে সারি সারি চিনা লণ্ঠন। যা জ্বলে উঠবে প্রতি পরবে। একপাশে রাখা জপযন্ত্র ও পুঁথি। প্রতি সকালে প্রার্থনা হয় নাকি। এটুকুতেই মন ভরছিল না আমার। আমাকে উশখুশ করতে দেখে একগাল হাসলেন লিয়েনমিন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় অনুসরণ করলাম তাঁকে।
আর উঠেই…
কাঁটা দিয়ে উঠল গায়ে। দেয়াল জুড়ে অসামান্য সব চিত্র। বুদ্ধের বিভিন্ন রূপ-বর্ণনা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ‘মহাযান’ বৌদ্ধধর্ম মিলেছিল তন্ত্রের বহু ধারার সঙ্গে। যার ফলে বহুরূপে শাক্যমুনি, পূজিত হন চিন ও জাপানে। কয়েক পা এগিয়েই একটা বিশাল গ্রন্থাগার। সেখানে তাকে থরে থরে সাজানো, চিনা ভাষায় লেখা ধর্মীয় পুঁথি। বই। লিয়েন মিন নিজেও হয়তো জানেন না, যে তিনি আগলাচ্ছেন কোন রত্নভাণ্ডার...
ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বললেন, ‘এই মন্দির আর বেশিদিন থাকবে না।’ আঁতকে উঠি আমি। এই রত্নভাণ্ডারের উপর দিয়ে বুলডোজার চলে যাবে, দৃশ্যটা কল্পনা করেই হাড় হিম হয়ে গেল। একটু ভালো করে ঠাহর করে দেখি, সত্যিই তো! দেওয়ালে পলেস্তারা খসে পড়ছে। এদিকে ওদিকে শ্যাওলার ছোপ। একা মানুষের পক্ষে এত বড়ো একটা মন্দিরের পরিচর্যা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া, উৎসব ব্যতীত এদিকে কেউ আসেও না। ফলে ফাঁকাই পড়ে থাকে প্রণামীর বাক্স।
মন্দিরের ফটক খুলে বেরোতে বেরোতে, সূর্য নামল পাটে। কানে আসছিল প্রার্থনাগৃহ থেকে মৃদুমন্দ ধ্বনি...
‘বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি
ধম্মং শরণং গচ্ছামি
সংঘং শরণং গচ্ছামি…’
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ভিক্ষু লিয়েন মিন, হিউয়েন সাং মন্দির, জেনিফার লিউ
চিত্রঋণ: মৃত্তিকা গুহ
Powered by Froala Editor