‘ঘুম পাড়ানি মাসি পিসি মোদের বাড়ি এসো।’ সেই কোন ছোট্টবেলায় এসব ছড়া, গান আর গল্প শুনে ঘুমোতে যেতাম। আজকের এই ব্যস্ত ও জটিল জীবনে এসে, বারবার মনে পড়ছে সেই একচিলতে ঘর, শান্ত পরিবেশ আর চিরপরিচিত গল্পগুলো। আমরা প্রত্যেকেই এসব শুনে বড়ো হয়েছি, গল্পও এতটুকু আলাদা নেই কোথাও; তবুও কী করে যেন সব এক হয়ে গেছে। শুধু কি বাংলা? গোটা পৃথিবী জুড়ে এমন কত মন ভোলানো কাহিনি ছড়িয়ে আছে! আর সেসব বলতে গেলেই একজনের নাম বারবার চলে আসবে সামনে। এবং নিশ্চিত, আপনাদের মনেও সেই নামটি এসেছে। হ্যাঁ, আজকের গল্প ‘ঈশপের গল্প’…
ঈশপের নাম শোনেনি, বা তাঁর গল্প পড়েনি এমন মানুষ বোধহয় প্রায় দুর্লভ। প্রত্যেকের বাড়িতেই একটা না একটা ঈশপের গল্পের বই আছে। আর না থাকলেও, পাঠ্যবই তো আছেই। সেই যে অহংকারী খরগোশটাকে দৌড় প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিল ‘অলস’ কচ্ছপ। কিংবা খেতে না পেয়ে ‘আঙুর ফল টক’ বলে ফিরে যাওয়া শেয়ালটার কথা। এই সবটাই তো ঈশপের সৌজন্যেই জানা। তাঁর গল্পে পশুপাখিরাও কথা বলে; এবং সহজ কথায় জীবনের মূল মন্ত্রগুলো বলে দিয়ে যায়। আর অজান্তেই হয়ে যায় আমাদের নিত্যসঙ্গী।
কিন্তু কে ছিলেন এই ঈশপ? কী করে এই গল্পগুলো তৈরি হয়েছিল? এই প্রশ্নও তো আমাদের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে বহুদিন ধরে। আর অদ্ভুত কথা, যার তৈরি করা গল্পগুলো কয়েক হাজার বছর ধরে জীবিত রয়েছে, তার স্রষ্টার সম্পর্কে খুবই কম জানা যায়। অনেকটাই ধোঁয়াশায় ভরা। মনে করা হয়, খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৬২০ থেকে ৫৬০-এর মধ্যে বর্তমান ছিলেন ঈশপ। বর্তমান তুর্কির কাছাকাছি কোনো একটা অঞ্চলে জন্মেছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে যখন ঈশপের জনপ্রিয়তা কিংবদন্তির আকার নিল, তখন অন্যান্য জায়গা থেকেও একই দাবি জানানো হল। কখনও আফ্রিকা, কখনও আবার জাপান, ইংল্যান্ড— সবাই চায় তাঁর জন্মস্থানের ভাগীদার হতে। তবে আদতে সেটি ঠিক কোথায়, তা নিয়ে অবশ্য আজও গবেষণা জারি আছে।
হেরোডোটাস, অ্যারিস্টটলের মতো প্রাচীন দার্শনিক ও ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে জানা যায়, ঈশপ আদতে ক্রীতদাস ছিলেন। আর সেই সময় ক্রীতদাসদের জীবন ঠিক কেমন ছিল, সেটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে রাখা দরকার, তখনও গ্রিস আর রোমের সভ্যতা অস্ত যায়নি। জ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস চর্চার মাঝে এমন অদ্ভুত রীতিও জারি ছিল। আর তারই দাস ছিলেন ঈশপ। কিন্তু কোথায় বলে না, জীবন সবাইকেই কিছু না কিছু সুযোগ দেয়। আর সঙ্গে দেয় প্রতিভাও। দ্বিতীয় বিষয়টি ঈশপের মধ্যে ভরপুর ছিল। তাঁর সহজাত বুদ্ধি, হাস্যরস, বিচক্ষণতার ঝলক প্রায়শই দেখা যেত। প্রকৃতির মাঝে বসে সেখান থেকেই গল্পের রসদ খুঁজে পেতেন। আর ছিল মানুষ। এই সবকিছু মিলেই তৈরি হত জাদু। তৈরি হত ঈশপের গল্প।
আরও পড়ুন
বিড়াল মারা যাওয়ার দুঃখে চোখের ভ্রু কেটে ফেলতেন প্রাচীন মিশরীয়রা!
কিন্তু ভাগ্য সঙ্গ না দিলে যা হয়। ক্রীতদাসের জীবন থেকে এত সহজে তো মুক্তি মিলছে না। এদিকে দেখতেও খুব একটা ভালো নন তিনি। তাঁর চেহারা দেখে আর গলার আওয়াজ শুনে বাকি লোকেরা ঠাট্টা-তামাশাও করত। সেইসঙ্গে ছিল মালিকরা। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, নিজের জীবনে মোট দুজনের দাসত্ব করেছিলেন ঈশপ। প্রথম মনিবের কাছ থেকে অবহেলাই জুটেছে। কিন্তু দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা তেমনটা নয়। ঈশপের বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর দ্বিতীয় মনিব। এবং তারপরই তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলেন তাঁকে। মুক্ত হলেন ঈশপ, একটা অন্য জগত যেন খুলে গেল তাঁর সামনে…
নিজের জীবনকালে নানা জনের কাছে গল্প বলে বেরিয়েছেন ঈশপ। তাঁর বলার ধরণ এবং গল্পের জন্য অচিরেই লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল নাম। সাধারণ সব গল্প, কিন্তু সেই সহজতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে জীবনের মানে। গ্রিস, রোমের রাস্তায় রাস্তায় ঈশপের গল্প ছড়িয়ে পড়ল। শোনা যায়, বন্দি অবস্থায় কারাগারের ভেতর বসে সক্রেটিস নাকি ঈশপের কিছু গল্পই লিখে রাখার কাজ করেছিলেন। কিন্তু ঈশপের জীবনকালে কখনও লিপিবদ্ধ করা হয়নি এই কাহিনিগুলো। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে ডেমেত্রিয়াস প্রথমবার ঈশপের গল্পগুলিকে একসঙ্গে করে সংকলন বের করেন। তখনই প্রথমবার লিখিত আকারে পাওয়া গেল এই কাহিনি। বাকিটা তো এক কিংবদন্তির যাত্রা। আমাদের জীবনের সঙ্গে যা জড়িয়ে গেছে ওতপ্রোতভাবে…
আরও পড়ুন
মানুষের খুলি দিয়ে তৈরি মিনার! মেক্সিকোতে উদ্ধার প্রাচীন ইতিহাস
Powered by Froala Editor