দেখতে দেখতে কেটে গেল অনেকগুলো বছর। ২৬ বছরে পা দিল ‘কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’। বিশ্বব্যাপী করোনা অতিমারী ও সংশ্লিষ্ট নানা জটিলতার মধ্যেও রাজ্যের তথ্য-সংস্কৃতি বিভাগের বার্তা, ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’। আসলে এই উৎসব যে একটা ঐতিহ্য, একটা ইতিহাসের ধারক। ১৯৯৫ সালের সেই প্রথম দিনটা ছিল বহু বছরের অপেক্ষার অবসান। প্রস্তুতিপর্ব শুরু হয়েছিল ১৯৮৩ সালেই। ’৯৫-তে প্রথম স্বাধীনভাবে রাজ্যে শুরু হল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। নন্দন চত্ত্বরে তখন চাঁদের হাট। দেশবিদেশ থেকে নানা চলচ্চিত্র নির্মাতা, কলাকুশলী এসে হাজির হয়েছেন। এর মধ্যেই ঠিক হয়ে গিয়েছে, নন্দনের সীমিত আসন সংখ্যার বাইরে বেরিয়ে কিছু ছবির প্রদর্শনী হবে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ইন্ট্যালেকচুয়াল ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এই উৎসব হয়ে উঠতে চাইল পপুলিস্ট কালচারের ধারক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, কমল হাসান, মিঠুন চক্রবর্তীর মতো বলিউডের জনপ্রিয় তারকারাও।
তবে এর আগেও ছিল আরেক উৎসব। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই শুরু হয়েছিল সেই উৎসব। ‘ভারত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’। ১৯৫২ সালে মুম্বাইতে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পর দেশের নানা শহরে ঘুরিয়ে দেখানো হয় সেই সিনেমার আয়োজন। সেই উৎসব হাজির হয়েছিল কলকাতাতেও। উৎসবের সাক্ষী ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন। প্রত্যেকের চেতনার জগতেই বিশেষ ছাপ ফেলে গিয়েছিল সেই উৎসব। সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, “চলচ্চিত্র উৎসব শেষ হবার পর আমার মনে আর কোনও সংশয় থাকে না যে আমি ছবিই তুলব। ‘পথের পাঁচালী’ হবে আমার প্রথম ছবি। ছবি যদি ভাল না হয় তো মাথা নিচু করে ফিরে যাব কিমারের কাছে। আর যদি উতরে যায় তো একটার পর একটা ছবি করে যাব।” আসলে দেশবিদেশের নানা ধরণের ছবির সাক্ষী হয়ে প্রত্যেকেই খুঁজে পেয়েছিলেন চলচ্চিত্রের এক নতুন ভাষা। আর সেইসঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন, সাজানো প্রেমকাহিনির বাইরে গিয়ে অন্যরকম ছবি দেখার মতো রুচি এবং ধৈর্য বাংলার দর্শকের আছে। শুধু তেমন ছবির জোগান নেই।
ঋত্বিক ঘটকও সেদিনই সিনেমাকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর ‘যুদ্ধের অস্ত্র’ হিসাবে। ‘নাগরিক’ এবং ‘পথের পাঁচালী’-র মতো সিনেমা বদলে দিতে শুরু করল বাংলা সিনেমার ভাষা। এর মধ্যেই আরও কয়েকবার ‘ভারত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এর আয়োজন হল কলকাতা শহরে। তবে তার জন্য তাকিয়ে থাকতে হত দিল্লির সিদ্ধান্তের দিকে। বাঙালি চলচ্চিত্র নির্মাতারা চাইছিলেন, রাজ্যের স্বাধীন উদ্যোগেই অনুষ্ঠিত হোক একটি উৎসব। ঠিক এই সময়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিকল্পনা করল এমন এক চলচ্চিত্র কমপ্লেক্সের, যেখানে এক ছাদের তলায় থাকবে অনেক সিনেমা হল, সেমিনার কক্ষ, চলচ্চিত্র লাইব্রেরি। বছর দুয়েকের মধ্যে সমস্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি হয়ে গেল ‘নন্দন’। বাংলার চলচ্চিত্র জগৎ যেন খুঁজে পেল নিজস্ব একটি মানমন্দির। প্রেক্ষাগৃহের দ্বারোদঘাটন থেকে শুরু করে প্রতীকচিহ্নটির নকশা অঙ্কন, সবই করলেন সত্যজিৎ রায়। এই সময়েই তিনি বললেন, “আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসবের যেটি সবচেয়ে মূল্যবান কাজ; অর্থাৎ দেশ-বিদেশের চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের একটি সুযোগ করে দেওয়া; সেটা মনে হয় নানান বিশৃঙ্খলা সত্ত্বেও অটুট থাকবে।”
একটু একটু করে জমতে থাকা স্বপ্ন পূর্ণতা পেল ১৯৯৫ সালে। দেশবিদেশের ছবির আয়োজন তো থাকলই, বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাতারাও খুঁজে পেলেন নিজেদের কথা বলার জায়গা। অবশ্য সমস্ত পরিকল্পনার পিছনে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম ছিল যে মানুষটির, সেই সত্যজিৎ রায় ততদিনে সিনেমার জগৎ ছাড়িয়ে অনেক দূরে পাড়ি দিয়েছেন। তবু তাঁর স্বপ্ন সার্থক রূপ পেয়েছে। আর দেখতে দেখতে সেই স্বপ্নের ২৬-এ পা পড়ল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ২৬ তম বছরের উদ্বোধন হয়ে যাবে। আগামী একসপ্তাহ ধরে ৮টি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হবে বাছাই করা সব সিনেমা। এসবের মধ্যে দিয়েই তো কৃষ্টিচর্চার ইতিহাসকে ছুঁয়ে থাকবে বাঙালি।
আরও পড়ুন
হিন্দি ও ফরাসি চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন সৌমিত্র, হাত পাকিয়েছেন পরিচালনায়
তথ্যসূত্রঃ কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র-উৎসব, চণ্ডী মুখোপাধ্যায়, কালি ও কলম
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
পিছিয়ে গেল কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, দিন ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর