কজঙ্গল থেকে গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে কর্ণসুবর্ণে এসেছিলেন। তাঁর প্রভাবে গোটা কর্ণসুবর্ণ জুড়ে বৌদ্ধপরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। পরবর্তীকালে সম্রাট অশোক সেই ভ্রমণকে স্মরণীয় করে তুলতে কর্ণসুবর্ণের রাক্ষসী ডাঙাতে চারটি বৌদ্ধস্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। শশাঙ্ক পরবর্তী সময়েও চিনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ কর্ণসুবর্ণ সহ রাঢ়দেশীয় উত্তরভূমির গ্রামগুলি ভ্রমণ করেছিলেন। এই অঞ্চলের গ্রামগুলির বৌদ্ধসংস্কৃতির কথা তাঁর লেখাতে পাওয়া যায়।
এইসময়ের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রাম ছিল সাল্যগ্রাম (বর্তমানে যার নাম সালার)। সাল্যগ্রাম ছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের স্থান। বৌদ্ধপরিমণ্ডল দ্বারা আবৃত অঞ্চল। বর্তমানে সালার বাদ দিয়েও সুনুটিয়া, সুনিয়া থেকে গীতগ্রাম পর্যন্ত ছিল বৌদ্ধ পরিমণ্ডলের অংশ। যদিও বর্তমান কাগ্রামে তেমন কিছু পুরানো নিদর্শন মেলেনি। অথচ কাগ্রামের নাম এসেছে কঙ্কগ্রাম থেকে এবং কঙ্কগ্রামের নামটি কঙ্ক দেবী থেকে।
সালারে 'দহ পুষ্করিণী' থেকে প্রচুর বৌদ্ধ দেবদেবীর ভগ্নাবশেষ এবং বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসশেষের চিহ্ন পাওয়া গেছে। অনেকে মনে করেন, এটাই ছিল সেনরাজাদের রাজধানী স্বর্ণগ্রাম। প্রচলিত জনশ্রুতি, এককালে এখানেই ছিল শালিবাহন রাজাদের রাজধানী এবং শালিবাহন নাম থেকে সালার নামের উৎপত্তি। যদিও শালিবাহনরাজের কোনও ঐতিহাসিক নিদর্শন মেলেনি।
বলা যায়, সেনযুগ থেকেই এই অঞ্চল বৌদ্ধসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, সাল্য গ্রাম বা সালার ও কঙ্কগ্রাম বা কাগ্রাম একই অঞ্চলের পাশাপাশি অংশ এবং এখানকার জাগ্রত অধিষ্ঠাত্রী হলেন দেবী কঙ্ক। দেবী কঙ্ককে অনেকে বৌদ্ধ তন্ত্রযানের দেবী মনে করেন। কালক্রমে তা হিন্দুত্বের আকার নিয়ে দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে পূজিত হয়।
আর একটি মত হল, কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রচলিত জগদ্ধাত্রী পূজার জৌলুস দেখে এখানে পূজা শুরু করেন কাগ্রামের মহাশয় বাড়ির এক ধনাঢ্য ব্যক্তি। এই মহাশয় বাড়ির পূজাই এখানে সবচেয়ে প্রাচীন। তবে এই গ্রামের জৌলুস অনেকটাই বাড়ে মুর্শিদাবাদের নবাবের খাস মানুষ শ্রী হর বক্সির হাত ধরে। অত্যন্ত ধনী এই ব্যক্তি কাগ্রামের পরিকাঠামোগত উন্নতি ছাড়াও এখানে তৈরি করেন সুদৃশ্য দুটি টেরাকোটার শিব মন্দির। মহাশয় বাড়ির নাম থেকেই মহাশয় পাড়ার নামকরণ হয়েছে। এই বাড়ির পূজার বিশেষত্ব হল শত শত মহিষ বলি। এছাড়াও আদি পূজা পদ্ধতি মেনে এখানে কুমারী পূজাও হয়।
মহাশয় বাড়ি ছাড়াও এখানকার অন্যতম একটি বিখ্যাত পূজা হল ব্রহ্মপদ রায়চৌধুরী বাড়ির পূজা। এই পূজা ১৪০ বছরের পুরানো। কাগ্রামের জমিদার সুরেন্দ্রনাথ রায়চৌধুরীর মা রাধারানী দেবীর সময় থেকে এই বাড়িতে পূজা শুরু হয়। এছাড়াও এখানকার অন্যতম বিখ্যাত পূজা হল ১২২ আগে শুরু হওয়া সাত আনার পূজা। বসন্তকুমারী দেবীর হাত ধরে এটির প্রচলন হয়, পরে তাঁর উত্তরাধিকারীরা এই পূজা করে আসছেন।
আরও পড়ুন
দুর্গার বিকল্প জগদ্ধাত্রী, কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরেই ‘পরাধীন’ বাংলায় শুরু পুজো
তবে এদের মধ্যে রায়চৌধুরী বাড়ির শোভাযাত্রা ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। এছাড়াও এখানে দে'বাড়ি, মিস্ত্রি বাড়ি ও বন্দ্যোপাধ্যায় বাড়ির পূজা বিখ্যাত। এখানকার পাল বাড়ির পূজার জগদ্ধাত্রী মূর্তি আসত কোলকাতার কুমোরটুলি থেকে। সে যুগে এটাই ছিল অন্যতম ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে চন্দননগর, ভদ্রেশ্বর বা হুগলি জেলার বাইরে মুর্শিদাবাদের প্রত্যন্ত গ্রামে এমন আয়োজন আমাদের চমকে দেয়। এখানে সাবেক বনেদিআনা ও বারোয়ারির সর্বজনীন পূজাগুলোর মিশেল একবারে অনবদ্য। ২২টি পূজা, তাদের আলোকসজ্জা এবং বিসর্জনের সময় গ্রাম পরিক্রমাতে যেন একে অপরকে তাক লাগিয়ে দেয়।
সমস্ত পূজাগুলির মূল বৈশিষ্ট্য হল নবমীর দিনে প্রত্যেক পূজা কমিটির তরফে রকমারি বাজনার আয়োজন। কার কমিটি কত বাজনাদার ও কত রকমের বিচিত্র বাজনা আছে তাই নিয়ে শুরু হয় রেষারেষি। দশমীতে প্রতিটি কমিটি তাদের প্রতিমাগুলিকে নিয়ে সারারাত গ্রাম পরিক্রমা করে পরের দিন সকালে বিসর্জন করে। ২৯টি পাড়া এবং ২২ হাজার জনসংখ্যাবিশিষ্ট এই গ্রামটি পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বড়ো গ্রাম, জগদ্ধাত্রী পূজাতে বহিরাগত মানুষের ঢল নামলে তিনদিন এই অঞ্চল মানুষের মিলনোৎসবের রূপ নেয়।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দুর্গোৎসবের পথেই হাঁটল চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো, প্রবেশ নিষেধ দর্শনার্থীদের