অলংকার-সমেত প্রতিমার বিসর্জন, এমনই বৈভব ছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোয়

উনবিংশ শতকের প্রথম দিক। নিজের বাড়িতে বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন রাজা রামমোহন রায়। হঠাৎ আগমন হল এক অতিথির। তাকিয়ে দেখেন, সদর দরজা দিয়ে গুটি গুটি পায়ে ভেতরে ঢুকল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির ছোট্ট সদস্য, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বন্ধু দ্বারকানাথের পুত্র সে; বহু আগে থেকেই রামমোহনেরও স্নেহধন্য। মাঝে মাঝেই চলে আসে এই বাড়ি। এবারের আগমনের কারণটি অবশ্য অন্য। ঠাকুরদা রামমণি ঠাকুরের হয়ে বিশেষ আমন্ত্রণ নিয়ে রায়বাড়িতে এসেছে ছোট্ট দেবেন্দ্রনাথ। কীসের আমন্ত্রণ? না, দুর্গাপূজার। দ্বারকানাথেরও ইচ্ছে, প্রিয় বন্ধু এই উৎসবে একটিবার বাড়িতে আসেন। এদিকে ব্রাহ্ম রামমোহন পড়লেন মহা মুশকিলে! অবাকও হলেন। শেষ পর্যন্ত নিজে না গেলেও, ছেলে রাধাপ্রসাদকে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজায় পাঠিয়েছিলেন রামমোহন… 

‘কফি হাউজের আড্ডাটা’ আজও কোনোক্রমে থাকলেও, ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপূজা মুছে গেছে সেই কোন কালে! কিন্তু তার বৈভব, জাঁকজমক এখনও কলকাতার শিরায় শিরায় ঘুরে বেড়ায়। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই নিজের লেখায়, আঁকায় পুজোর দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। এবং আক্ষেপ করেছেন সেই পুরনো দিনগুলোর দিকে তাকিয়ে। যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদালান সেজে উঠত নানা রঙে, কাঁসর আর ঢাকের আওয়াজে গমগম করত পরিবেশ। আর তার মাঝেই শোভা পেত প্রতিমা…

শুরুটা হয়েছিল সেই অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। পাথুরিয়াঘাটার দর্পনারায়ণ ঠাকুরের সঙ্গে বিষয়সম্পত্তি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তাঁর দাদা নীলমণি ঠাকুর। শেষমেশ পরিবার নিয়ে চলে আসেন জোড়াসাঁকো অঞ্চলে। ততদিনে নিজেও যথেষ্ট সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পত্তনও তাঁরই হাত ধরে। সেখানেই নীলমণি ঠাকুর ১৭৮৪ সালে দুর্গাপূজা শুরু করেন। প্রথমদিকে সেরকম জাঁকজমক ছিল না এই পুজোয়। নিজের সাধ্যের মধ্যে যেটুকু পারতেন, সেটুকু দিয়েই মা’কে ভরিয়ে দিতেন নীলমণি। তবে সময় তো একরকম থাকে না। একদিন ঠাকুরবাড়ির কর্তা হিসেবে উঠে আসেন নীলমণি ঠাকুরের নাতি, দ্বারকানাথ ঠাকুর। বলা যায়, তাঁর আমল থেকেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পুজো লোকের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। 

হঠাৎ এমন পরিবর্তন কেন? দ্বারকানাথের বুদ্ধি, পরিশ্রম আর দক্ষতা ততদিনে কলকাতার দিকে দিকে প্রচারিত। তাঁর রাজকীয় জীবনযাপন ঠিক যেন রাজাদের মতো। দেখতে দেখতে কেবল প্রতিপত্তিই নয়; বিষয়-সম্পত্তি-বৈভবে ভরে উঠল জোড়াসাঁকো। আর তারই মধ্যমণি হয়ে রইলেন ‘প্রিন্স’ দ্বারকানাথ ঠাকুর। এখন তো টাকার কমতি নেই; তাহলে কেন ধুমধাম করে দুর্গাপূজা হবে না? যেমন ভাবা তেমনি কাজ। বিশাল বড়ো ঠাকুরদালানে শুরু হল প্রতিমা তৈরি। একচালার সাবেকি প্রতিমা; কাজে এতটুকুও ফাঁক থাকত না। তবে আসল চমক দেখা যেত আসল পুজোর সময়। 

আরও পড়ুন
কলকাতার প্রাচীনতম দুর্গাপুজোয় ভোগ পান অসুরও; ৪০০ বছরেও বদলায়নি সেই রীতি

বলা হয়, পুজোর আগে নাকি ঠাকুরবাড়ি থেকে আকাশে শঙ্খচিল উড়ে যেত। এই শঙ্খচিলই মা দুর্গাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে। আর দশমীর দিন ছিল নীলকণ্ঠ পাখি। ঠাকুরবাড়ির প্রতিমায় একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। বলা হত, একচালা প্রতিমার মুখটি নাকি তৈরি করা হত দ্বারকানাথের স্ত্রী, দিগম্বরী দেবীর আদলে। এতই নাকি রূপবতী ছিলেন তিনি! পুজোর দিনগুলোয় নিয়ম করে দু’বেলাই প্রতিমার পরনের শাড়ি বদলানো হত। আর সঙ্গে থাকত বহুমূল্য সব গয়না। সমস্ত কিছু দিয়ে দেবীকে সাজানো হত। আর সেই রোশনাই ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত জায়গায়। আর দেবীর ভোগ হিসেবে যা আয়োজন করা হত, পরে সেসব বাইরের মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হত। দ্বারকানাথ ঠাকুরের বাড়ির পুজো বলে কথা, যে সে ব্যাপার নাকি! 

তবে এর মধ্যে থেকেই উঠে আসে আরও একটি মিথ। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কাছেই শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়ি। এখানকার পুজোও শহরের অন্যতম বিখ্যাত বনেদি পুজো। মা দুর্গা নাকি মর্তে এসে আগে শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে যান গয়না পরতে— এমনটাই ছিল প্রবাদ। সত্যিই, গয়নার জাঁকজমকে অন্য পুজো থেকে একটু আলাদাই জায়গা করে নিয়েছিল এই বাড়ি। ঠাকুরবাড়িতেও আয়োজন কম ছিল না। সেখানেও প্রচুর গয়না দিয়ে সাজানো হত প্রতিমাকে। তাও দ্বারকানাথের মনে হল, কিছু একটা যেন কম হচ্ছে। তারপর প্যারিস থেকে নিয়ে এলেন বিশেষ গয়না। প্রতিমাকে শুধু সাজালেনই না; দশমীর দিন বিসর্জনের সময় সেই সালংকারা প্রতিমাকেই বিসর্জন দিলেন দ্বারকানাথ! মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল খবর। গোটা কলকাতা দেখল দ্বারকানাথের বৈভব… 

আরও পড়ুন
অষ্টমীর বেলুড় মঠ; ‘জ্যান্ত দুর্গা’ সারদামনির পুজো করলেন বিবেকানন্দ

একটু একটু করে বাংলার পুজোর মানচিত্রে একটা জায়গা তৈরি করেছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পুজো। একসময় হঠাৎ করেই সেসব বন্ধ হয়ে গেল। তখন শহরে ব্রাহ্ম ধর্মের হাওয়া। দ্বারকানাথের প্রিয় বন্ধু ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। ব্রাহ্মদের সমর্থন করলেও, নিজে কোনদিন সেই পথে হাঁটেননি দ্বারকানাথ। কিন্তু পুত্র দেবেন্দ্রনাথের বেলায় সেটা হল না। রামমোহন রায়কে দেখেই ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আগ্রহ বাড়ে তাঁর। একটু একটু করে সেই সাধনায় নিজেকে জড়িয়ে নেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে যান ব্রাহ্মসমাজের প্রধান মুখ। তাঁর দেখাদেখি ঠাকুরবাড়ির বাকিরাও ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন। এদিকে এই ধর্মে তো মূর্তিপূজা মানা! ধীরে ধীরে দুর্গাপূজার দিক থেকে মন উঠে গেল দেবেন্দ্রনাথের। যে কদিন চলেছিল, তিনি পাহাড়ের নির্জনে চলে যেতেন। একটা সময় যে পুজোর বৈভব ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা বাংলায়, সেটাই বন্ধ হয়ে গেল একটা সময়। কিন্তু ইতিহাস, মিথ? না, সেসব মুছে যায়নি। কলকাতার বনেদি পুজোর আঙিনায় আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে ঠাকুরবাড়ির পুজোর কথা…

ছবি - প্রতীকী

আরও পড়ুন
কামানের গর্জন থেমেছে আগেই; ২৫০ বছরে কেমন আছে আন্দুল রাজবাড়ির দুর্গাপুজো?

Powered by Froala Editor

More From Author See More