স্মৃতি থেকে মুছে গেছে অনেক গয়নাই, অলঙ্কার বাঙালির গল্প

"আমার গহনা পিতাঠাকুর দেন, হাতে চালদানা, পলাকাটি, মাদুলি, পঁইছা, বাউটি, তাবিজ, বাজুদানা, কন্ঠমালা। পায়ে ছয়গাছা মল, পাঁইজোর, গকরি, পথম ও চুটকি। কানে বোঁদা ও মাছ। কোমরে চন্দ্রহার, গোট, চাবি ও শিকলি।" 

মুশকিল হল এই সমস্ত গহনা শাশুড়ি নিয়ে তাঁর ভিক্ষা পুত্রের বৌকে দিয়ে দিলেন। বদলে তিনি তাঁর নিজের বৌমাকে দিলেন "আশী ভরির ঝুমুর দেওয়া ছয়গাছা মল। আশী ভরির পাঁয়জোর, বালা, ডামনকাটা, পাড়িখাড়ু, হাতহার, চালদানা, নবংগকলি, ৪০ ভরির বাউটি, ১৪ ভরির গোলমালা, ১২ ভরির তাবিজ, ৫ ভরির বিল্বপত্র বাজু, গোপহার, মুকুতার কন্ঠি , পানহার, সিঁতি, দো-নর মুকুতা, ২৮ ভরির চন্দ্রহার, কানবালা, কানফুল, ঝুমকা, চৌদানি, মুক্তার গোছা, দুটি ছোট ঝুমকা, দুটি ছোট ফুল আর পিপুলপাত।"

যা লিখলাম তা কিশোরীচাঁদ মিত্রের স্ত্রী কৈলাসবাসিনী দেবীর ‘গহনার ফর্দ’-র কিছু অংশ। আরও আছে। এ তো গেল বিয়ের গহনা। এ ছাড়াও নানা অনুষ্ঠানে, পুজোতে বাবুর গিন্নিদের জন্য ভারী ভারী গয়না বানাতেন। সে সময় একটু সম্পন্ন গৃহস্থ মানেই প্রচুর গয়নাগাটি। সেগুলো তাঁরা পরতেন, জমাতেন, বাক্স খুলে খুলে দেখতেন। অন্দরমহলে এই গয়নাগুলোই ছিল তাঁদের প্রাণ। মরেও তাঁদের গয়নার বাসনা যে যেত না, তা রবি ঠাকুর ‘মণিহার’ গল্পে দারুণ দেখিয়েছেন। তাঁর বাড়ির বউরাও প্রচুর গয়না পড়তেন। প্রফুল্লময়ী দেবীর স্মৃতিকথায় তাঁর গয়নার যা বিবরণ পাই, তা শুনলে আজকালকার মহিলাদের হিংসে হবেই। অনেক গয়নার নামও আজকাল শোনা যায় না। গোড়ে, ছালনা, পিন খাড়ু, চাউদানি এয়ারিন, দমদম গোখরি বা ঝাঁপা যে কীরকম গয়না ছিল, তা বিস্তারিত গবেষণার দাবি রাখে। কিন্তু এইসব পরে প্রসন্নময়ীকে ঘুরতে হত, আর সে জন্য তিনি বিন্দুমাত্র প্রসন্ন ছিলেন না। বিরক্ত হয়ে লিখেছেন "সারাদিন এই ছয় সাত সের ওজনের গহনা পরিয়া চলাফেরা করিতে হইত।"

ধীরে ধীরে শুধু সাজসজ্জা থেকে গহনা স্ত্রী ধনে পরিণত হয়। বিপদে পড়লে "এই গয়নাই আমাকে রক্ষা করিবে" এই ধারণা প্রায় বদ্ধমূল হয়ে যায়, যা থেকে আজও অনেকে রেহাই পায়নি। নাকে নথ ও নোলক ছিল এয়োতির চিহ্ন, যদিও দুটোই মুসলিমদের হাত ধরে হিন্দু সমাজে এসেছিল। ফাঁদি নথ এত বড় হত যে তার ভিতর দিয়ে অনায়াসে ভাত খাওয়া যেত। গ্রাস তোলার সময় শুধু নথটাকে টানা দিয়ে আটকে রাখতে হত, এই যা। 

আমার ঠাকুরমা নাকের মাঝের সেপ্টামে একটা অদ্ভুত গয়না পড়তেন। দুই দিক চাপা বোতামের মত। নাম নাকঠাসা। কেন পরতেন? জিজ্ঞাসা করায় জবাব পেয়েছিলাম স্ত্রীর নিঃশ্বাস স্বামীর গায়ে সরাসরি পড়া নাকি অশুভ। সোনা শুদ্ধ জিনিস। নাকের অশুভ বাতাস পিউরিফায়েড হয়ে স্বামীর গায়ে পড়ত। ভেবে বেজায় হাসি পেয়েছিল, যতদিন না জেনেছি এককালে পুব বাংলায় সত্যি সত্যি নাকঠাসা এই কারণেই পরা হত। 

নাকে নোলক পরলে কান কি ফাঁকা থাকবে? তার জন্য ছিল গোসওয়াড়া, বাহাদুরি, ঝমকা, বালা, খুংরিদার, পতং, তান্দুর... 

মুসলিমরা বাংলায় আসার আগে মেয়েদের মাথার গয়না বলে কিছু ছিল না। মানে টায়রা আর টিকলি কী জিনিস, তা তাঁদের অজানাই ছিল। তবে মাথায় ফুল আর ফুলের মালার ব্যবহার ছিল, আজও আছে। সিঁথিতেও অনেকে ফুল পরতেন। পরে কিভাবে সিঁদুর এল, তা নিয়ে অন্য একদিন লেখার ইচ্ছে আছে। খুব সম্ভব অতীতের টায়ার রাজ্য থেকে টায়রা বাঙালি হিন্দু সমাজে এসেছে। 

দিন পাল্টাতে লাগল। মেয়েরা মাথার অলঙ্কার হিসেবে পরতে লাগলেন চৌঙ্ক, শিষফুল, ছোটি ও মৌলি। কপালে পরতেন দমনি, কুটবি, তাওয়াইট, চাঁদটিকা, ঝুমর, গুছই, বারোয়াট আর বিন্দলি। এই বিন্দলিই পরে বিন্দি নাম নিয়েছে। 

আগের লেখার কানের কিছু গয়নার নাম বলেছি। তবে বাঙ্গালীদের মধ্যে বীরবৌলি আর মদনকড়ি নামে দুটি কানের গয়না সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। কানবালা, কানপাশা আর কান - এই তিনতেই অবশ্য মুঘলদের দান। 

নাকের নথ নিয়ে আগের লেখায় কিছু আছে। আজ আর দুই একটা ব্যাপার না বললেই নয়। নবাবী আমলে স্বামীর সম্মান অনুযায়ী স্ত্রী নথ পরতে পারতেন। এলি তেলি যে কেউ নথ পরবে, সেটা ভাবাই যেত না। শ্রীহট্টের গৌররাম রৈ ছিলেন নবাবের একেবারে কাছের মানুষ। অনেকদিন ধরে নবাবের কাছে দরবার করে অবশেষে ১১৫৬ সালের ২২ আষাঢ় এক অদ্ভুত ফরমান বের করলেন নবাব। তাতে গৌররাম রৈ- এর পরিবারের মহিলাদের পুরুষানুক্রমে(নাকি মহিলানুক্রমে) নাকে নথ পরার অনুমতি দেওয়া হল। বাঙালি হিন্দু মহিলার নথ পরা সেই প্রথম। তবে পায়ের সোনার নুপুর একমাত্র রাজপরিবারের মেয়েরা ছাড়া কেউ পরতে পেত না। কেশব সেনের মেয়ে সুনীতি দেবীর বিয়ের পরে তিনি এই ভেবে আনন্দ পেয়েছিলেন এবার কুচবিহার রাজবাড়িতে গিয়ে তিনি সোনার নূপুর পরতে পারবেন। 

নাকের গয়নার মধ্যে বেশ কটা ডিজাইন বেশ চলত। তাই মেয়েরা বাপের বাড়ি এলেই পুরোনো গয়না ভেঙে নতুন ডিজাইন বানাতেন। স্বর্ণকার বাড়ি আসতেন গয়নার ডিজাইন নিয়ে। কি অদ্ভুত সব ডিজাইন, কি দারুণ তাঁদের নাম - মাক্কি। কেশর, ডালবোলাক, চানবোলাক, হীরাকাট বোলাক। নাকছাবিরও কত কায়দা - ডালিমফুল, লবঙ্গ, বড়োইফুল, চালতাফুল, দামালকাট... মানে নকশা অনুযায়ী আর কি। 

গলার হারে মুক্তার মালার চল সবচেয়ে প্রাচীন। বৈদিক যুগের। তবে উনবিংশ শতকে চম্পাকলি, হাঁসুলি, ইতরাবদন, গুলবন্ধ, কান্দি, মোহরণ, হাউলদিল নামে নানা রকম গলার হার পরতেন মেয়েরা। জানি না এদের কয়টা এখনও প্রচলিত। মেয়েরা ভালো বলতে পারবেন। 

হাতের গয়নার বেশ কটার নাম আমার মতো বেদো লোকও জানি। এগুলো তখনও ছিল। আজও কটা টিঁকে আছে। বাজুবন্ধ (বললেই গান মনে পড়ে 'বাজুবন্ধ খুল খুল যায়'), তাবিজ, অনন্ত, বাউটি, মানতাসা আর রতনচূড়। মানতাসা হল অনেকটা রিসলেটের মতো। কিন্তু এই গয়না বেশ ভারি এবং চওড়া। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এগুলো কনের মায়ের, দিদিমার বা ঠাকুমার লকারে তোলা থাকে। কারণ বেশ পুরনো দিনের গয়না, এটি পরা হয় কব্জির কাছে বা রিস্টে। এটি চওড়া ও চৌকো আকৃতির হয় এবং সঙ্গে চেন লাগানো থাকে। রতনচূড় হাতের উপরভাগ অর্থাৎ তালুর উল্টো দিকে এটি পরা হয়। কব্জির কাছে এটি চুড়ির মতো আটকানো থাকে এবং বাকি অংশ ছড়িয়ে হাতের আঙুলের সঙ্গে লাগানো থাকে। কেউ কেউ এটি সোনার পরেন তবে এটি অনেকটাই ছড়ানো হয় এবং দু’হাতে পরা হয় বলে অনেকটা সোনা লাগে। রতনচূড়কে আজকাল হাতপদ্ম বলে। তবে ভাওটা, জসমবাঁক, কুলুপিয়ার নাম এ যুগের মেয়েরা কেউ শুনেছেন নাকি জানা নেই। 

হাতের গয়না বলছি যখন আংটির কথা না বললে চলে না। শকুন্তলার আমল থেকে আংটি চলেছে। আরশি আর ছল্লা নামে দুই রকম আংটি ছিল, বড়ো আকারের যাদের তর্জনীতে পরতে হত। আঙুল তুলে কথা বলতে সুবিধে হত বোধহয়। কোমরে পরার জন্য ছিল পাহজেব, বঞ্জর, জিঞ্জির। যাদের পয়সাকড়ি কম তাঁরা বউদের কোমরে পরার জন্য কিনে দিতেন গোটাহার, আর নিমফল। 

এই সমস্ত গয়না পরে বউকে কেমন লাগত? তাঁরও আখ্যান আছে। লিখেছেন বেগম রোকেয়া। এক সালঙ্কারা বধূর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। মেয়েটি নাবালিকা ( যথারীতি), তাঁর " মাথায় সিঁথির অলঙ্কার ৪০ ভরি, কর্ণে ২৫ ভরি, কণ্ঠে ১২০ তোলা, সুকোমল বাহুলতায় প্রায় দুই সের, কটি দেশে ৬৫ ভরি, চরণযুগলে ২৪০ ভরি স্বর্ণের বোঝা!"

গয়না নিয়ে এইটুকুই থাক। দয়া করে ‘বোঝা’ শব্দটা খেয়াল করবেন।

Powered by Froala Editor